বেসরকারি ৬৭ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদে পদে আইন লঙ্ঘন
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ২৫ অনিয়ম চিহ্নিত
ঢাকার বাইরের দশা বেশি করুণ, ৫ সদস্যের কমিটি * ২৮টিতে ভিসি, ৬৮টিতে প্রোভিসি এবং ৪৩টিতে কোষাধ্যক্ষ নেই, মালিকরা বছরের পর বছর ভিসি-কোষাধ্যক্ষ
দেশের ৬৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত ২৫ ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে চলছে পদে পদে আইন লঙ্ঘনের প্রতিযোগিতা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের (বিওটি) সদস্যরা নিজেদের স্বার্থে এসব অনিয়ম-দুর্র্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন।
এর ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোতে মানসম্মত উচ্চশিক্ষা বিঘ্নিত হচ্ছে। সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার চালানো দেশব্যাপী অনুসন্ধানে এ চিত্র উঠে এসেছে। সংস্থাটি সম্প্রতি তাদের প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দাখিল করে।
সে আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেয়া হয়। পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ৫ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে।
এ নিয়ে কথা হয় ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নানের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘একটি সংস্থা বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমের ওপর দফাওয়ারি অনুসন্ধান চালিয়েছে। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনের আলোকে কার্যক্রম গ্রহণে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় আমরা কমিটি গঠন করেছি।
নানা কারণে কমিটি কাজ শুরু করতে পারেনি। তবে শিগগিরই কমিটি সরেজমিন পরিদর্শন শেষে সুপারিশমালা তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো
হবে।’ শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসির কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির সদস্যরা হলেন- ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক আখতার হোসেন, অধ্যাপক ইউসুফ আলী মোল্লা,
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবদুল্লাহ আল হাসান চৌধুরী, ইউজিসির সচিব ড. মো. খালেদ এবং কমিটির সদস্য সচিব ইউজিসির উপ-পরিচালক জেসমিন পারভীন।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে চিহ্নিত অনিয়মগুলোর মধ্যে রয়েছে- ভিসি, প্রোভিসি, কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ না করা; এসব পদে দায়িত্বপ্রাপ্তদের একাধিক পদ দখলে রাখা; একই ব্যক্তির বছরের পর বছর একই পদে থাকা।
কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত ভিসি, প্রোভিসি ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ না করে বছরের পর বছর সাময়িক দায়িত্ব দিয়ে রাখা। আছে সনদ বাণিজ্য ও নানা ছুতোয় কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিওটি সদস্যদের টাকা তুলে নেয়ার বিষয়।
ভবনের ভাড়া ও বৈঠকের নামে মাত্রাতিরিক্ত অর্থ তুলে নেয়া এবং দেশের বাইরে বিওটির বৈঠকের নামে দেদার অর্থ খরচের বিষয়টিও উঠে এসেছে। এছাড়া রয়েছে কর ফাঁকি, জাল সদনে শিক্ষার্থী ভর্তি, ভর্তি বাণিজ্য, বিদেশি শিক্ষার্থীর তথ্য গোপন, অতিরিক্ত অর্থ আদায়।
২০১০ সালের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী ন্যূনতম ১০ বছরের শিক্ষকতাসহ ২০ বছরের অভিজ্ঞরা হবেন ভিসি ও প্রোভিসি। কোষাধ্যক্ষকেও ন্যূনতম ১৫ বছরের অধ্যাপনার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কিন্তু বিধি লঙ্ঘন করে অন্য পেশার ব্যক্তিদের ভিসি-প্রোভিসি-ট্রেজারার পদে নিয়োগ করা হচ্ছে।
এক্ষেত্রে একটি নিরাপত্তা বাহিনীর অবসরপ্রাপ্তদের বসানোর প্রবণতা বেশি। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে মালিকরাই ভিসিসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে আছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলের অর্থে বিওটি সদস্যরা অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় জমি কিনেছেন। সাধারণ তহবিল থেকে ট্রাস্টিদের আর্থিক সুবিধা গ্রহণের তথ্য আছে। কোনো কোনো লাইব্রেরিতে হিজবুত তাহরীরের বই রাখা হয়।
এছাড়া বাণিজ্যিক ভবনে ক্লাস নেয়া ও নির্ধারিত আসনের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তির অভিযোগ আছে। নিয়োগ নীতিমালাও নেই অনেক প্রতিষ্ঠানে। এমন বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে যেখানে ভিসিসহ ৬ জন শিক্ষক দিয়ে পাঠদান চলছে। প্রতিবেদনে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের অনেকেই গৃহিণী- এসব তথ্যও উঠে এসেছে।
মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ভর্তির কোটা-নীতি অনুসরণ না করার প্রবণতা খুব বেশি। এক্ষেত্রে ৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। বাকিগুলোরও একই দশা বলে জানান ইউজিসির কর্মকর্তারা।
প্রতিবেদনে ভিসি, প্রোভিসি ও কোষাধ্যক্ষদের নাম-ঠিকানা, বিওটির সঙ্গে তাদের সম্পর্কের রসায়ন, রাজনৈতিক পরিচয় তুলে আনা হয়েছে। ‘বিবিধ অনিয়ম’ কলামে উঠে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার ফিরিস্তি। ‘মন্তব্য’ কলামে অভিযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে সুপারিশ করা হয়।
প্রতিবেদনে ৬৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৫টিতে ভিসি, ৩২টিতে প্রোভিসি এবং ২০টিতে কোষাধ্যক্ষ নেই। তবে গত ২০ মার্চ ইউজিসির সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, ৯০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২৮টিতে ভিসি, ৬৮টিতে প্রোভিসি এবং ৪৩টিতে কোষাধ্যক্ষ নেই। দেশে মোট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৯৭টি। বাকিগুলোর কার্যক্রম শুরু হয়নি।
গোয়েন্দা প্রতিবেদন বলছে, ৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিওটি সদস্যরা জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ৭টির বিওটি সদস্যদের কেউ বিএনপি এবং কেউ জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
প্রতিবেদন বলছে, ঢাকার বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ের দশা বেশি নাজুক। এর মধ্যে ফরিদপুরের টাইম ইউনিভার্সিটির ব্যাপারে বলা হয়েছে, ১০ তলা ভবন ভাড়া নিয়ে পরিচালিত হলেও এটি চলছে যেনতেনভাবে। ভিসিসহ ৬ জন শিক্ষক আছেন।
ভিসি মাসে দুই-একবার ক্যাম্পাসে আসেন। অন্য শিক্ষকদের বিভাগ পরিচালনার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা নেই। এসব বিষয়ে ইউজিসির ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে মন্তব্য করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্বের কথা বলা হয়েছে। দশ হাজার শিক্ষার্থীর ভবিষ্যতের কথা মাথায় নিয়ে দ্বন্দ্বের নিরসন দরকার। মালিকানা দ্বন্দ্ব আছে ইবাইস এবং স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েও।
চট্টগ্রামের ইস্ট ডেলটা ইউনিভার্সিটিতে অতিরিক্ত অর্থ আদায় ও ড্যাফোডিল বিদেশি শিক্ষার্থীদের তথ্য গোপন করেছে। মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বহুদিন ধরে চলছে ভারপ্রাপ্ত ভিসি দিয়ে, নেই প্রোভিসিও। ভর্তিতে আদায় হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এশিয়ান ইউনিভার্সিটির বিওটির চেয়ারম্যানই (মালিক) ভিসি। গত দেড় বছর ধরে তিনি রাষ্ট্রপতির মনোনয়ন ছাড়াই আছেন। এ প্রতিষ্ঠানে নেই প্রোভিসি-কোষাধ্যক্ষ। উত্তরা ইউনিভার্সিটিতে ভিসি ড. এম আজিজুর রহমান ২০০৬ সাল থেকে আছেন।
প্রতিবেদনে অতীশ দীপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি বাণিজ্য, অতিরিক্ত ফি আদায় ও মুক্তিযোদ্ধা কোটা প্রতিপালন না করার কথা বলা হয়েছে।
বিভিন্ন দিক তুলে ধরে ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, টাইম ইউনিভার্সিটিসহ কয়েকটির বিরুদ্ধে প্রতিবেদনে ‘যথাযথ ব্যবস্থা’ নেয়ার সুপারিশ রয়েছে। বলা হয়েছে, ঢাকার উত্তরার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে নৈতিকস্খলন, মালয়েশিয়ায় টাকা পাচার, শিক্ষকদের কম বেতন দেয়া, যখন-তখন ছাঁটাইয়ের অভিযোগ থাকলেও প্রতিবেদনে তা স্থান পায়নি।
এ ব্যাপারে প্রতিবেদনের ওপর কার্যক্রম গ্রহণের লক্ষ্যে গঠিত কমিটির একজন সদস্য যুগান্তরকে বলেন, প্রতিবেদনটি পাঠিয়ে আমাদের তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। তবে ব্যবস্থা বা তদন্তের ক্ষেত্রে প্রতিবেদনকেই আমরা একমাত্র মানদণ্ড ধরব না, তথ্যের একটি প্রাথমিক উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
No comments
Post a Comment