Breaking News

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়: প্রাসঙ্গিক ভাবনা-২

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ শিক্ষাবান্ধব না ব্যবসাবান্ধব?
[DOES PRIVATE UNIVERSITY ACT 2010 EDUCATION FRIENDLY OR BUSINESS FRIENDLY?]
সরকারের মন্ত্রী, ইউজিসির চেয়ারম্যান মিলে দ্বিপাক্ষিকভাবে একদিকে বলে বেড়াচ্ছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দূর্ণীতি, অনিয়ম এবং সনদ বিক্রি হচ্ছে, আবার অন্যদিকে এসব দূর্ণীতি, অনিয়ম এবং সনদ বিক্রি বন্ধের জন্য সুসপষ্ট কোন আইন তৈরি করতে পারেনি, যা নীচের প্রতিবেদনে উঠে আসবে বলে আশা করি।





সুশীল ব্যক্তি ছাড়াও আরও অনেকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে অনেক সাফাই গেয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ এর বারোটা বাজিয়েছেন। তারপরও তারা বলে বেড়াচ্ছেন যে, এ আইনটি শিক্ষাবান্ধব, মালিক বান্ধব হয়নি। আমি আশা করবো নীচের আলোচনায় প্রতীয়মান হবে যে, এ আইনটি উচ্চশিক্ষার জন্য কতটা উপযুক্ত।


বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ এর আকার বা সাইজ হচ্ছে ৮.৫ ইঞ্চিঢ ৫.৫ ইঞ্চি কাগজের ১২ পাতা বা ২৪ পৃষ্ঠা, যা ৮.৫ ইঞ্চি ঢ১১ ইঞ্চির হলে পাতা হতো ৬টি এবং পৃষ্টা হতো ১২টি, যা একটা ছোট চটি বইয়ের চেয়েও ছোট, যাকে বলা যায় একটা আদর্শলিপি বইয়ের থেকেও ছোট। এ হচ্ছে বিদ্যমান ৫৪/৫৬ টি এবং আরো নতুন অনুমোদনের অপেক্ষায় প্রহর গোনা ৬০-৭০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের রক্ষাকবচ এর সাইজ। বিস্ময়কর সাইজ বললে অত্যুক্তি হবেনা। তবে এ কবচ মালিকদের জন্য, না শিক্ষার্থীদের জন্য তা নিয়ে এন্তার লেখালেখি হয়েছে। নীচের বিশ্লেষণটি পাঠে প্রশাসনের যোগ্যতা ও দক্ষতা, রাজনীতিবিদদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এবং আইনটি কার স্বার্থে প্রণীত হয়েছে তা প্রমাণিত হবে বলে আশা করছি। প্রথমেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ এর দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক যে, এ আইনটা কতটা যুক্তিযুক্ত, উপযোগী, যুগোপযুগী, প্রয়োজন, মানসমপন্ন, শিক্ষাসহায়ক, শিক্ষাবান্ধব না কি বানিজ্যবান্ধব বা মালিক বান্ধব! প্রথমেই এর সংজ্ঞা দিয়ে শুরু করা যাক:


সংজ্ঞা: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ এর প্রথমেই ধারা ২ এর সংজ্ঞায় কোন ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়নি। যে উদ্দেশ্যে এ আইন করা হয়েছে তার সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে ধারা ২ এর উপ-ধারা (৭) এ, যেটা হওয়া উচিত ছিল ধারা ২ (১) এ। ধারা ২(৬) হওয়া উচিত ছিল ধারা ২(২) এ। এভাবে ধারা ২(৮) হওয়া উচিত ছিল ২(৩), ২(১২) হওয়া উচিত ছিল ২(৪), ২(১) হওয়া উচিত ছিল ২(৫), ২(১৮) হওয়া উচিত ছিল ২(৬), ২(২) হওয়া উচিত ছিল ২(৭), ২(৩) হওয়া উচিত ছিল ২(৮), ২(৪) হওয়া উচিত ছিল ২(৯), ২(১৫) হওয়া উচিত ছিল ২(১০), ২(১৬) হওয়া উচিত ছিল ২(১১), ২(১৭) হওয়া উচিত ছিল ২(১২), ২(৯) হওয়া উচিত ছিল ২(১৩), ২(১৪) হওয়া উচিত ছিল ২(১৪), ২(৫) হওয়া উচিত ছিল ২(১৫), ২(১৩) হওয়া উচিত ছিল ২(১৬), ২(১১) হওয়া উচিত ছিল ২(১৭) এবং ২(১০) হওয়া উচিত ছিল ধারা ২(১৮)। এটা নিছক ধারনা। এ ধারনা পুরোপুরি সঠিক না হলেও কাছাকাছি। এভাবে সংজ্ঞায়িত করলে হয়তো ধারাবাহিকতা কিছুটা রক্ষা হতো এবং সুন্দর হতো। আর এভাবে আইনের বিস্তারিত বিবরণেও ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সম্ভব হতো। যাহোক, সংজ্ঞায় অনুষদের বিষয়টি সংজ্ঞায়িত করা হলেও বিভাগের কোন সংজ্ঞা দেয়া হয়নি। আরো কিছু বিষয় সংযোজন ও সংজ্ঞায়িত করা যেতো।


সনদ: ধারা ২(১৪) তে সনদপত্র অর্থ এই আইনের অধীন প্রদত্ত সনদপত্র দ্বারা কি বুঝানো হয়েছে? বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রদত্ত সনদ, না কি ছাত্র-ছাত্রীদেরকে প্রদত্ত সনদ? বিশ্ববিদ্যালয়কে সনদ দেয়ারতো কোন প্রয়োজনই নেই। তাদেরকে প্রথমে সাময়িক অনুমোদন/অনুমতি এবং সকল শর্ত পূরণ শেষে স্থায়ী অনুমোদন/অনুমতি বা লাইসেন্স (যেহেতু এটাকে ব্যবসা হিসাবে গন্য করা হয়) প্রদান করা যেতে পারে। কাজেই এখানে সনদ শব্দটি অপ্রাসঙ্গিক। ধারা ৫, ৬, ৭ ও ১১ তে সাময়িক অনুমতি শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু ধারা ৮, ৯, ১০ ও ১২-তে সনদপত্র শব্দটির প্রয়োগ করা হয়েছে, যা সঠিক কি না ভেবে দেখা দরকার। সাময়িক অনুমোদন/অনুমতির সাথে স্থায়ী অনুমতি/অনুমোদনের সমপর্ক থাকতে পারে, কিন্তু সাময়িক অনুমোদন/অনুমতির পরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সনদ লাভের কোন সমপর্ক থাকতে পারেনা। সনদপত্র শব্দটি কেবলমাত্র ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠ সমাপনের পরে অর্জিত সনদকেই বুঝাতে বা বুঝতে হবে।


স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়: ধারা ২(৯) এ স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় বলতে এই আইনের দ্বারা বা আইনের অধীন প্রতিষ্ঠিত কোন বিশ্ববিদ্যালয়কে বুঝানো হয়েছে, তার মানে এই আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কোন বিশ্ববিদ্যালয় সরকার কর্তৃক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। একদিকে বলা হচ্ছে অনুমতি, আবার বলা হচ্ছে স্বীকৃত। বিষয়টা একটু কন্ট্রাডিক্টরী হয়ে গেলনা? সরকার কর্তৃক অনুমতিপ্রাপ্ত বলতেইতো সরকার কর্তৃক স্বীকৃতকে বোঝায়। সরকারের অনুমোদন লাভ মানেই সরকার স্বীকৃতি দিয়েছে-তাই নয়কি?


বোর্ড অব ট্রাস্টিজ: ধারা ১৫-তে বলা হয়েছে, প্রত্যেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও পরিচালনার জন্য একটি বোর্ড অব ট্রাস্টিজ থাকিবে এবং উক্ত বোর্ড এর সদস্যগণের মধ্য হইতে একজন সদস্য বোর্ড অব ট্রাস্টিজ এর সভাপতি নির্বাচিত হইবেন। ধারা ১৬ তে আছে এ ট্রাস্টিজ এর ক্ষমতা ও দায়িত্ব। কিন্তু ট্রাস্টিজ এর গঠনপ্রণালীর বিষয়ে কোন নির্দেশনা এ আইনের ১৫ ও ১৬ ধারায় উল্লেখ নেই। একটা মাত্র বাক্য আছে ধারা ৬(১)-এ, যেখানে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও পরিচালনার উদ্দেশ্যে অনধিক ২১ কিন্তু অনূন্য ৯ সদস্য বিশিষ্ট একটি বোর্ড অব ট্রাস্টিজ গঠন করিতে হইবে, যা ধারা ১৫-এর অধীনে থাকা উচিৎ ছিল । তাছাড়া কোন্ কোন্ ব্যক্তি বোর্ড অব ট্রাস্টিজ এর সদস্য হতে পারবেন বা পারবেন না, তার কোন নির্দেশনা নেই। ফলে দেখা যাচ্ছে যে, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করছেন বা টাকা দিচ্ছেন, তিনিই ট্রাস্টিজ এর সভাপতি হচ্ছেন এবং তিনি তার স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে (সাবালক, নাবালক উভয়ই), তার আত্মীয়-স্বজন, তার আজ্ঞাবহ (কৃতদাস)-দেরকে ট্রাস্টিজ এর সদস্য বানিয়ে ক্ষমতার যথেচ্ছা ব্যবহার/প্রয়োগ করছেন। এ ধারনা শুধুমাত্র বিশেষ কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রযোজ্য নয়। অনুমোদনপ্রাপ্ত ৫৪/৫৬ টির অধিকাংশই একাজ করেছে। উল্লেখ্য, সরকার ও ইউজিসি সবসময়ই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে মালিক বলেই সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে থাকে, আর তারাও মালিক সেজে বসে আছে। অথচ আইনের কোন ধারায় মালিক বলে কোন শব্দ নেই। বিধি অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোন ব্যক্তিগত সমপত্তি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয়।


অনুষদ বা স্কুল অব স্টাডিজ: আইনের ২১(১) অনুযায়ী প্রত্যেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনূন্য তিন (৩) বা ততোধিক শিক্ষা অনুষদ বা স্কুল অব স্টাডিজ থাকিবে উল্লেখ আছে। যদি তিনটি অনুষদ ও ছয়টি বিভাগসহ ২৫ হাজার বর্গফুটের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়, তবে প্রতি বিভাগে ছাত্রছাত্রীর মোট সংখ্যা অনুমেয়। কিন্তু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্রাতিরিক্ত ছাত্রছাত্রীর মোট সংখ্যা আমাদের ভিন্ন চিত্র প্রদর্শন করে। কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয় দাবী করে যে, তাদের যে স্থায়ী ক্যামপাস আছে এবং তাতে নির্দেশিত ২৫ হাজার বর্গফুটেরও বেশি আছে, তাহলে তাদের সমস্যা কোথায়? এখানেই তাদেরকে পন্ডিতের সাথে মুর্খের একটা সেতুবন্ধন তৈরি করে পন্ডিতমূর্খ উপাধি দেয়া যেতে পারে। এসব পন্ডিতমূর্খরা কি জানেনা যে, এ ২৫ হাজার বর্গফুটের নির্দেশনাটি কেবলমাত্র প্রাথমিক পর্যায়ে ৩টি স্কুল বা অনুষদ এবং এর অধীন ৬টি বিভাগ নিয়ে যারা নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করবে তাদের জন্যই প্রযোজ্য? যারা আইন প্রণেতা এবং যাচাই বাছাইকারী তারাও এ বিষয়টি সপষ্ট করেননি যে, এ ২৫ হাজার বর্গফুটের বিষয়টি কেবলমাত্র নতুন আবেদনকারীদের জন্য প্রযোজ্য হবে। যখন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫-৬টি অনুষদ বা ফ্যাকাল্টির অধীন ২০-২৫টি প্রোগ্রাম চালু থাকে তখন এ ২৫ হাজার বর্গফুটে স্থান সংকুলান হবে কী? আসলে এসব পন্ডিতমূর্খরা সরকারকে বোকা বানানো বা ধোকা দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে এবং নিজেদেরকে অতিচালাক ভাবছে।


অর্থ কমিটি: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের জন্য আইনে বর্ণিত বিধিবদ্ধ পর্ষদ বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃত্ব হলো : ১. ট্রাস্টি বোর্ড, ২. সিন্ডিকেট, ৩. একাডেমিক কাউন্সিল, ৪. অনুষদ, ৫. বিভাগ, ৬. ইনস্টিটিউট, ৭. পাঠক্রম কমিটি, ৮. অর্থ কমিটি, ৯. শিক্ষক নিয়োগ কমিটি, ১০. শৃঙ্খলা কমিটি ইত্যাদি । উলি্লখিত কমিটিগুলোর মধ্যে সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলের সভাপতি হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর। এটা ঠিক আছে, কিন্তু আইনের ২৫(২) ধারা মতে অর্থ কমিটির সভাপতি করা হয়েছে, ট্রাস্টি বোর্ডের মনোনীত তিনজন সদস্যের ভেতরে একজনকে। এ একজনের মনোনয়নের জন্য কোনো প্রক্রিয়া বা নির্দেশনা বা বিধি-বিধান আইনে বর্ণিত না হওয়ার ফলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের খেয়াল খুশিমত লোকদেরকে অর্থ কমিটিতে স্থান দিয়ে আর্থিক সুবিধা নিতে সক্ষম হবে।


শিক্ষক নিয়োগ কমিটি: আইনের ধারা ২৭ এ শিক্ষক নিয়োগ কমিটি গঠন এর বিধান উল্লেখ আছে। কিন্তু শিক্ষক নিয়োগের বেলায় কিসের উপর ভিত্তি করে (শিক্ষকদের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা) উক্ত কমিটি শিক্ষক নিয়োগ করবে তার কোন নির্দেশনা বা বিধি-বিধান বর্তমান আইনে উল্লেখ নেই। যার ফলে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগের একটা সুযোগ থেকে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির কারনে কম বেতনে শিক্ষক নিয়োগের একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। বর্তমান আইনে সরাসরি কোন নির্দেশনা না থাকায় তারা আবার ধুয়া তুলবে যে, বর্তমান আইনে এ ধরনের কিছু নেই।


ভাইস চ্যান্সেলর: ধারা ৩১ এর ধারাবাহিকতাও রক্ষা করা হয়নি। যেমন-৩১(৩) হওয়া প্রয়োজন ছিল ৩১(২), (৪) হওয়া উচিত ছিল (৩), ধারা (৫) হওয়া  ছিল (৪), (২) হওয়া উচিৱত ছিল (৫), (৭) হওয়া উচিত ছিল (৬), (৮) হওয়া উচিত ছিল (৭), এবং ধারা ৩১(৬) হওয়া উচিত ছিল ৩১(৮)। যাহোক, ২০১০ আইনের ধারা ৩১(৩) এ বলা হয়েছে: উপ-ধারা (১) এর অধীন ভাইস-চ্যান্সেলর পদে নিয়োগের জন্য প্রথম শ্রেণী বা সমমানের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী, অথবা পিএইচডি ডিগ্রি এবং কোন স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ে অনু্যন ১০(দশ) বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাসহ গবেষণা বা প্রশাসনিক কাজে মোট ২০ (বিশ) বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। আইনের ৩১(৩) ধারাটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়: (১) বলা হয়নি এই ১০(দশ) বছরেরশিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় তার পদবী কী থাকতে হবে-প্রভাষক, সহকারি অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক নাকি অধ্যাপক? (২) কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে নাকি শুধুমাত্র কলেজে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকলেই চলবে? (৩) বা শব্দটি প্রয়োগ করে 'গবেষণা বা প্রশাসনিক' শব্দ দুটি দিয়ে আইনটিতে একটা জটিলতা সৃষ্টি করা হয়েছে। কারন গবেষণা এবং প্রশাসনিক এক বিষয় নয়। গবেষণা হচ্ছে একাডেমিক আর প্রশাসনিক বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্নতর। বা শব্দটির সুবিধা নিয়ে প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার প্রয়োজনটিকে অস্বীকার করার সুযোগ থাকবে। গবেষণা বা প্রশাসনিক-অর্থ্যাত যে কোন একটি অভিজ্ঞতার সুবিধা বেছে নেয়ার সুযোগ তারা গ্রহণ করতে পারবে। বা শব্দটি প্রয়োগ করা প্রশাসনিক কাজের অভিজ্ঞতাটা এখানে গৌণ করা হয়েছে। এর ফলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দুণর্ীতি করার আরো কিছু সুযোগ-সুবিধার ভোগের মওকা পেয়ে গেল। যেমন-একজন প্রভাষকের যদি যে কোন কলেজে ১০(দশ) বছরের শিক্ষকতা এবং ১০ (দশ) বছরের গবেষণার বা প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা থাকে, তাহলেই বর্তমান আইনের অধীন ভিসি হওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন এবং তাকে ভিসি হিসেবে নিয়োগে কোন বাধা থাকবেনা। ধারা ৩১(৪) এ বলা হয়েছে 'ভাইস-চ্যান্সেলর' পদে নিয়োগের জন্য প্রস্তাবিত ব্যক্তি অন্য কোন বেসরকারি বা স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত থাকিলে ... ... ...। এখানেও জটিলতা তৈরি করা হয়েছে। স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় বলতে কি বোঝানো হলো? সরকারি-বেসরকারি সকল বিশ্ববিদ্যালয়ইতো সরকারের অনুমোদনপ্রাপ্ত। কোনটার খরচ সরকার চালায়, আর কোনটার খরচ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা ট্রাস্ট বা ঐ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চালায়। যে-ই চালাকনা কেন? সরকারের অনুমোদন নিয়েই চালায়। সে যাই হোক, এখানে বলা হয়েছে কর্মরত থাকিলে, বলা হয়নি কর্মরত থাকতে হবে। এর ফলেও দূর্ণীতিবাজ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়  কর্তৃপক্ষ ফায়দা লোটার চেষ্টা করবে। কারন আদালতের যুক্তি-তর্কে এ আইন দ্বারা কাউকেই দুর্নীতি থেকে মুক্ত রাখা যাবেনা। উপরন্তু আদালতই তাদের পক্ষে রায় দিতে বাধ্য হবে। কারন আইনেই সে সুবিধাটুকু করে দেয়া হয়েছে। ধারা ৩২ অনুযায়ী প্রো-ভিসি নিয়োগের বেলায়ও এই একই সমস্যা দেখা দিবে এবং এর ফলে যা ইচ্ছা তাই করার ধান্দায় থাকবে।


৩১(১) অনুযায়ী বোর্ড অব ট্রাস্টিজ কর্তৃক প্রস্তাবিত কোন ব্যক্তিকে ৪ বছর মেয়াদের জন্য চ্যান্সেলর ভিসি হিসাবে নিয়োগ দিবেন। কিন্তু একই ব্যক্তিকে কতবার কয় মেয়াদের জন্য ভিসি হিসাবে নিয়োগ করা যাবে, এ বিধানটি এবারেও সংযোজন করা হয়নি। সরকার ও ইউজিসি ১৯৯২ ও সংশোধিত ১৯৯৮ এর আইনানুযায়ী বারবারই বলে আসছিল যে, কোন ভিসির মেয়াদ ৪ বছরের বেশি হবেনা। কিন্তু কখনোই বলেনি যে, একজনকে কত বারের বা মেয়াদের বেশী নিয়োগ দেয়া যাবেনা। এ হিসাবে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগে সরকার অনীহাও প্রকাশ করেছিল এর আগে। অথচ এখনো কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক একজন ভিসি ৩-৪ মেয়াদের জন্য (১২-১৬ বছরের জন্য) নিযুক্ত হয়ে তাদের বানিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। একজনকে কতবার নিয়োগ করা যাবে-এ প্রশ্নটি যেহেতু সরকারই বারবার করে আসছিল এবং প্রশ্নটি অনেক পুরনো হওয়া সত্বেও আইনে কেন সংযোজন করা হলোনা, তা না বোঝার কারন বোধকরি ব্যাখ্যা করতে হবেনা। কারন সরকার, ইউজিসি এবং সংসদীয় যাচাই-বাছাই কমিটিকে ম্যানিপুলেট করে বা ম্যানেজ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমিতি বা মালিকপক্ষ যেভাবে ধারা ৪২ ও ৪৩-কে তাদের মত করে তৈরি করে নিয়েছে, এটাও সেরকমই । এ কতবারের বিষযটি সংযোজন না করায় একই ব্যক্তিকেই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভিসি নিয়োগের ব্যবস্থাটি আগের আইনের মতই পাকাপোক্ত রয়ে গেল। এ আইন পাশ করার পূর্বে এ বিষয়ে সরকার বরাবরই সোচ্চার থাকলেও আইন পাশের সময় এ বিষয়টি পাশ কাটিয়ে মালিকদের স্বার্থই সংরক্ষণ করা হয়েছে। পূর্বের আইনের অধীনে একটি নির্দেশনা/নীতিমালা ছিল, যেখানে ভাইস চ্যান্সেলর, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর এবং ট্রেজারার নিয়োগের নিমিত্তে চ্যান্সেলরের নিকট সুপারিশ পেশের সময় প্রত্যেক পদের জন্য বায়োডাটাসহ ৩ জনের আবেদন প্রস্তাব আকারে প্রেরণ করতে হবে। কিন্তু বর্তমান আইনে তা অন্তর্ভুক্ত না করে উপযুক্ত ব্যক্তিকে ভিসি, প্রো-ভিসি এবং ট্রেজারার নিয়োগে অন্তরায় তৈরি করা হয়েছে, যা শিক্ষার মানকে ব্যহত করবে বহুলাংশে এবং উপযুক্ত ভিসি, প্রো-ভিসি এবং ট্রেজারার নিয়োগ না দিয়ে শিক্ষাকে পণ্যে বা বানিজ্যে রূপান্তর করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ধারা ৩২ এবং ৩৩-এও ঐ একই সুবিধা ভোগ করবে।


খন্ডকালীন শিক্ষক: বর্তমান আইনের ধারা ৩৫(৩) অনুযায়ী, কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগ বা প্রোগ্রামের খণ্ডকালীন শিক্ষকসংখ্যা সংশ্লিষ্ট কোর্সের পূর্ণকালীন শিক্ষকসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের বেশি হইবে না...... এবং (৪) অনুযায়ী, কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কোনো শিক্ষক বা কর্মকর্তাকে কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হইলে ওই ব্যক্তির মূল নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত ছাড়পত্র গ্রহণ করিতে হইবে।

এখানে বলা যায়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পূর্ণকালীন শিক্ষক নিয়োগে অনীহার কারনে ছোট-বড় সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টির জায়গাটুকু দখল করে রেখেছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। এ ১৮ বছরেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষককে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ নিতে তাদের মূল প্রতিষ্ঠান থেকে কখনো ছাড়পত্র গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। তারা তাদের ইচ্ছামত কাজ চালিয়ে নিয়েছে। ইউজিসি এবং সরকারও এ বিষয়ে বারবার তাগিদ দিয়েও কোন ফল পায়নি এবং পদক্ষেপও গ্রহণ করতে পারেনি। ১৮ বছর ধরে এ বিষয়ে ইউজিসি কর্তৃক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে তাগাদা দিতে দিতে এমন অবস্থা হয়েছে যে, এসব তাগাদা এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কানের কাছে শুধু ঘ্যানর ঘ্যানর ছাড়া আর কিছুই নয়, তারা কেউই সরকারের এ নির্দেশনা আমলে নেয়নি। কাজ চালিয়ে গেছে নিজেদের ইচ্ছেমত। আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, যারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খন্ডকালীন হিসাবে পাঠদান করে থাকে, তারা মনে করে আমাদের কোন ঠেকা আছে? ঠেকা থাকলে আছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। ১৮ বছরে ইউজিসি এ কাজটিও করতে পারেনি। তাই সংশয় থেকেই গেল যে, এ ধারাটি কতটুকু কার্যকর হবে। কারন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ধরেই নিয়েছে যে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের ছাড়া চলতে পারবেনা। তাই তারা ছাড়পত্র গ্রহনেরও প্রয়োজন মনে করেনা। দেখা গেছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ভরশীলতা আরো বহুগুণে বেড়ে গেছে।


বিশ্ববিদ্যালয় সংবিধি: ধারা ৩৭-এ প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের সিন্ডিকেট কর্তৃক এই আইন, বিধি এবং সরকার ও ইউজিসি কর্তৃক প্রণীত আদেশ ও নীতিমালার আলোকে শিক্ষা, গবেষণা, প্রশাসনিক, আর্থিক ও অন্যান্য কার্যাদি সমপাদনের জন্য সংবিধি প্রণয়ন পূর্বক বোর্ড অব ট্রাস্টিজ ও সরকারের মাধ্যমে চ্যান্সেলরের অনুমোদন গ্রহণ করিবে। সরকার আইন পাশ করেছে জুলাই ২০১০ এ। এর মধ্যে চলে গেছে এক বছর। কিন্তু কোন বিশ্ববিদ্যালয়ই অদ্যাবধি কোন সংবিধি প্রণয়ন করে অনুমোদনের জন্য চ্যান্সেলরের নিকট প্রেরণ করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ইউজিসিও ২/১টি স্মরনীকা (রিমাইন্ডার) দিয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। যেখানে বর্তমান আইনটি পাশ হবার পর থেকে এ সময়ের মধ্যে সরকার নিজেই একটা এক্রিডিটেশন কাউন্সিলই তৈরি করতে পারেনি, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের চরিত্র পরিবর্তন করবে কেন? তারাতো জানেই যে, এ আইনতো একটা কাগজের চটি বই ছাড়া কিছুই নয়। তাছাড়া এসব সংবিধি দিয়ে সরকার বা ইউজিসি করবেটাইবা কী? তারা এগুলোর পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখে কোনদিন?


এক্রেডিটেশন কাউন্সিল: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের জন্য আইনের ৩৮(১) ধারা মতে, এক্রেডিটেশন কাউন্সিল গঠন করার কথা থাকলেও আইনটি পাশ হবার এক বছর পরেও তা সরকার করতে সক্ষম হয়নি। এটি গঠন করা অত্যন্ত জরুরি ছিল, কিন্তু যতদুর জানা যায়, এ কাউন্সিলটি এখনো সরকারের প্রক্রিয়াধীন! কবে আলোর মুখ দেখবে, তা ভবিতব্য।


ছাত্র-ছাত্রীদের রেজিস্ট্রেশন ও সনদ অর্জন: ধারা ৪০ এর (১), (২) ও (৩)-এ ছাত্র-ছাত্রীদের রেজিস্ট্রেশন বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া থাকলেও আইনের কোথাও তাদের পরীক্ষা গ্রহণ, উত্তরপত্র মূল্যায়ন, ইনভিজিলেশন, গ্রেডেশন, সনদ প্রদান ইত্যাদি অর্থ্যাৎ পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বা পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসের কার্যাবলীর উপর কোন দিক নির্দেশনা দেয়া হয়নি। তাছাড়া পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্বেও এ পদে নিয়োগের বিষয়ে চ্যান্সেলরের অনুমোদনের কোন বিধান রাখা হয়নি। ফলে সনদ বানিজ্যের পথ খোলাই রাখা হলো। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের মর্জিমাফিক (তাদের আর্থিক স্বার্থ সংরক্ষণের কারনে) যাকে তাকে নিয়োগ দিয়ে থাকে। যেখানে কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০-১২ বছর ধরে কোন বৈধ (চ্যান্সেলর কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত) ভিসি, প্রো-ভিসি এবং ট্রেজারারই নেই বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। সেখানে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের মত একটা গুরুত্বপূর্ন পদকে গুরুত্বহীন করে সনদ বানিজ্যের পথকে সুপ্রশস্ত করেছে বলেই ধরে নেয়া যায়।


অর্থায়নের উৎস: ধারা ৪১(৫)-এ বর্ণিত বিভিন্ন খাতে সৃষ্ট সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয়-এ উপ-ধারাটির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকা সরিয়ে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের সূযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। এর ফলে শিক্ষা খাতের সাথে ব্যবসা-বানিজ্য যুক্ত হয়ে শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য ব্যহত হবে। যদিও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষাকেই বানিজ্যিক পন্যে পরিণত করেছে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকা সরিয়ে অন্য কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া কতটা সুদূরপ্রসারী চিন্তার ফল, তা বোধকরি আর কাউকে বুঝিয়ে বলতে হবেনা। আইনের এ ধারাটির অপপ্রয়োগ ইতোমধ্যেই শুরু করে দিয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। এশিয়ানের ভিসি ইতোমধ্যেই কান্ডারী গ্রুপ নামে একটা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান চালু করে দিয়েছে। কান্ডারী গ্রুপের এ সংবাদটি www.newsleaks24.blogspot.com থেকে জানা গেছে। এছাড়াও www.kandarigroup.com ওয়েবসাইটটেও ভিজিট করলেই এর সত্যতা পাওয়া যাবে বলে ঐ ব্লগটি থেকে জানা গেছে।


শিক্ষার্থী ফি: বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয় নির্বাহের জন্য ধারা ৪২-এ দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার মানদন্ডে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটা শিক্ষার্থী ফি কাঠামো প্রস্তুত করিয়া বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনকে অবহিত করিবে। কমিশন অবহিত হবার পর প্রয়োজনে পরামর্শ প্রদান করিতে পারিবে (ইউজিসি অবহিত কপিটি তাবিজ বানিয়ে গলায় ঝুলিয়ে রাখিতে পারিবে)। ইউজিসি কি পরামর্শ প্রদান করিবে? এ আইন পাশ হবার এক বছর অতিক্রান্তের পরও অদ্যাবধি কোন বিশ্ববিদ্যালয় কী শিক্ষার্থী ফি নির্ধারন করে ইউজিসিকে অবহিত করেছে? যদি না-ই করে থাকে, তাহলে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেনা কেন?


বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ পাশ হবার পর গত বছরের (২০১০ সালের) শেষদিকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন কর্তৃক গত ১৬ সেপ্টেম্বরে জারি করা এক পত্রের মাধ্যমে বিদ্যমান সকল বিশ্ববিদ্যালয়কে আইনের বিভিন্ন ধারা উল্লেখ করে তা বাস্তবায়ন করে সরকার/ইউজিসিকে অবহিত করার জন্য ১৫ অক্টোবর ২০১০ পর্যন্ত (এক মাস) সময়সীমা বেধে দেয়া হলেও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই এ নির্দেশনার অধিকাংশই বাস্তবায়ন করে তা সরকার কিংবা ইউজিসিকে অবহিত করেনি। যেমন-ধারা ৯ অনুযায়ী *ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় জমি *উক্ত জমিতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে ভবনাদির প্ল্যান অনুমোদন ও অবকাঠামো নির্মান *বর্ণিত জমি কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিকট কোনভাবে দায়বদ্ধ বা হস্তান্তর করা যাবে না *বিনা বেতনে শিক্ষাদানের জন্য ৩% আসন মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান এবং ৩% প্রত্যন্ত অনুন্নত এলাকার দরিদ্র ও মেধাবীদের জন্য সংরক্ষণ *ক্যামপাসে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার্জন, চলাফেরা ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা *গবেষণার জন্যে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ রাখা *সকল শর্তাদি প্রতিপালন করা। ধারা ২৪ অনুযায়ী অনুমোদিত ক্যামপাসেই অনুমোদিত প্রোগ্রাম/কোর্স এবং ইনস্টিটিউট পরিচালনা, শিক্ষার্থী ভর্তি কিংবা ভর্তির জন্যে বিজ্ঞাপন বা লিফলেট বিতরণ করা। ধারা ১৪ অনুযায়ী বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ গঠন, ধারা ৬(১) অনুযায়ী ট্রাস্টি বোর্ড গঠন, ধারা ১৭ অনুযায়ী সিন্ডিকেট গঠন, ধারা ২৯(১) অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা নিয়োগ। শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত এবং বার্ষিক প্রতিবেদন প্রস্তুতের লক্ষ্যে একটি আভ্যন্তরীণ Quality Assurance Cell গঠন, ধারা ৪৩ অনুযায়ী শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উপযুক্ত! বেতন কাঠামো ও চাকুরী প্রবিধানমালা! প্রণয়ন, ধারা ৪২ অনুযায়ী দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার মানদন্ডে একটি শিক্ষার্থী ফি কাঠামো! তৈরি, নিয়মানুযায়ী বিনা বেতনে অধ্যয়নের সূযোগ প্রদান এবং সর্বশেষে ধারা ৪৭(১) অনুযায়ী সনদ গ্রহণ করা। এর মধ্যে যেগুলোর সাথে আর্থিক সংশ্লেষ নেই, শুধু সেগুলোর কিছুটা বাস্তবায়ন করলেও ধারা ৯ এর আংশিক, ধারা ২৪, ধারা ৪২, ধারা ৪৩, এবং ধারা ৪৭(১) এর ব্যাপারে খুব একটা অগ্রগামী কিংবা কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়েছে বলে দৃশ্যমান হয়নি।


বেতন কাঠামো ও চাকুরী প্রবিধানমালা: ধারা ৪৩ এ বলা হয়েছে, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য উপযুক্ত(!) বেতন কাঠামো ও চাকুরী প্রবিধানমালা প্রস্তুত করিয়া বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনকে অবহিত করিবে। কমিশন অবহিত হবার পর প্রয়োজনে পরামর্শ প্রদান করিবে (অবহিত কপিটি তাবিজ বানিয়ে গলায় ঝুলিয়ে রাখিতে পারিবে)। এ আইন পাশ হবার পরে অথবা পূর্বেই বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ফি বৃদ্ধি করলেও এদের মধ্যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ই অদ্যাবধি কোন শিক্ষক, কমর্কতা কিংবা কর্মচারীর বেতনতো বৃদ্ধি করেইনি, উপরন্তু বেতন কমিয়েছেন বলে প্রমান পাওয়া যায়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের বেতন স্কেল ১৪০০ টাকা এবং প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তাদের বেতন স্কেল ১২ হাজার টাকা। এতে তারা সাকুল্য বেতন পাচ্ছেন সর্বনিম্ন ৩ হাজার টাকা এবং সর্বোচ্চ ১৮ হাজার টাকা। বাকী যারা আছেন সবাই কনসোলিডেটেড। তাদের বেতনও ২ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকার বেশি নয়।


পরিদর্শন ইত্যাদি: ধারা ৪৬-এর বিবরন দেখে বলা যায়, এ হেডিংয়ের অধীনে ইউজিসির দায়িত্ব ও কর্তব্য বলা হয়েছে, কিন্তু হেডলাইনে পরিদর্শন ইত্যাদি (একটা শব্দের পর ইত্যাদি লেখা দেখে বুঝা যায় যে, আইন প্রণেতাদের শব্দের ভান্ডার খালি হয়ে গেছে) শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। হেডিংয়ে বলা উচিৎ ছিল ইউজিসির দায়িত্ব ও কর্তব্য/কার্যাবলী। যাহোক, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ এ ইউজিসির নিয়ন্ত্রণ পূর্বে প্রণীত আইনের চেয়ে কিছুটা ক্ষমতা বেশি রাখা হয়েছে। বর্তমান আইনে কোনো সংক্ষুব্ধ শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী বা শিক্ষার্থীর স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। আইনের ৪৬(৩)-এ উল্লেখ আছে, কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর নিকট হইতে প্রাপ্ত কোন অভিযোগের ভিত্তিতে, অথবা উপ-ধারা(১)-এর অধীন পরিদর্শনকৃত কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনাগত বা অন্য কোনো ত্রুটি বা গাফিলতির কারণে কোনো শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন বিপন্ন বা ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে বা কোনো শিক্ষক, কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে তাঁহার ন্যায্য পাওনা হইতে বঞ্চিত করা হইয়াছে বলিয়া প্রমাণিত হইলে, উক্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, কমিশনের নির্দেশক্রমে ওই শিক্ষার্থী বা ক্ষেত্রমতে শিক্ষক, কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করিবে। এ ছাড়া মঞ্জুরি কমিশন স্ব-প্রণোদিত হয়ে ৪৮(১) ধারা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়মের ব্যাপারে তদন্ত করতে পারে। এখানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিক্ষেত্রে বৈষম্য ও বঞ্চনা থেকে প্রতিকার পাওয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছে বলা হলেও এ ধারার উপ-ধারা (২), (৩) ও (৪) এর বিষয়ে ইউজিসির ভূমিকা পূর্বেও কোনদিন সহায়ক ছিলনা, বর্তমানেও নেই, ভবিষ্যতেও থাকার সম্ভাবনাই নেই। কারন ইউজিসির লোকজনের সাথে সাথে সেখানকার ইট, বালু, সিমেন্ট, চেয়ার, টেবিলও নাকি বুস্ট (ঘুষ) খায়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন লোক দেখলেই নাকি তারা সবাই হামলে পড়ে। ঘুষ (বুস্ট) ইজ দ্য সিক্রেট অব দেয়ার এনার্জি। বিগত ১০ বছরের অভিজ্ঞতায় ইউজিসির ভূমিকা তাই প্রমাণ করে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান থাকা আর না থাকার ভিতর কোন পার্থক্য নেই বলে বিজ্ঞজনেরা মনে করেন। বর্তমান ইউজিসি চেয়ারম্যানকে নাকি প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাকেতো সজ্জনই মনে হয়। দেখা যাক, মোল্লার দৌড় কতদূর ..................!!!!!!!!!!!!।


আদালত কর্তৃক অপরাধ গ্রহণ: পূর্বের (১৯৯২, সংশোধিত ১৯৯৮) আইনে অপরাধের জন্য ৩ বছরের কারাদণ্ড ও ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডের বিধান ছিল। বর্তমান আইনে তা যথাক্রমে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকার অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডের বিধান করা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী নবায়নসহ নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে সনদপত্র গ্রহণ না করলে সরকার ওই বিশ্ববিদ্যালয়কে সাময়িক স্থাপন ও পরিচালনার অনুমতি বাতিলসহ বন্ধ ঘোষণা করতে পারবে। এসব ভাল কথার বিপরীত চিত্রও পাওয়া যাবে এ আইনে। এ আইনের ধারা ৪৯(২)-এ আবার এও বলা হয়েছে যে, সরকার বা সরকারের নিকট হইতে এতদুদ্দেশ্যে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন কর্মকর্তার লিখিত অভিযোগ ব্যতিত কোন আদালত এই আইনের অধীন কোন অপরাধ বিচারের জন্য গ্রহণ করিবে না!!!!!!!!!!!!!। এখানেই সর্বনাশ যা করার, তা এখানেই করা হয়ে গেছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ এর ধারা ৪৯(১)-এ উলি্লখিত ধারাসমুহ লঙ্ঘন করিলে সরকার তা তদন্ত করিবার নিমিত্তে একজন উপযুক্ত! ব্যক্তিকে ক্ষমতা অর্পন করিবে। ঐ ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি হন্তদন্ত (তদন্ত) করে অভিযোগ দিলেই কেবলমাত্র আদালত তা আমলে নিতে পারিবে। সত্যি সেলুকাস, কী বিচিত্র এ দেশ-আর দেশের আইন প্রণেতারা। প্রশ্ন হচ্ছে, ঐ ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি যদি নিজেই বুস্ট খেয়ে তদন্ত রিপোর্ট লাল ফিতায় বেধে রাখে, তাহলে কী হবে? এই ধারা কি তখন প্রয়োগ করা সম্ভব হবে? আইনইতো এ পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। আমাদের দেশের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে, কোন ঘটনা ঘটলে হন্তদন্ত (তদন্ত) কমিশন নামে কিছু কমিশন হয়, কিন্তু ঐ পর্যন্তুই। এসব হন্তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট কোনদিন প্রকাশও হয়নি। আর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতেও দেখেনি কেউ কোন কালে। নইলে দেশের এ হাল হয়?

ব্লগে মন্তব্য করুন অথবা মেইল করুন: sangsaptaka@rocketmail.com

No comments