বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়: প্রাসঙ্গিক ভাবনা-১
প্রথমেই
একটা প্রশ্ন রেখে লেখাটা শুরু করা যেতে পারে। প্রশ্নটি হচ্ছে, পাবলিক
বিশ্ববিদ্যালয় বিরাজমান থাকাবস্থায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার
প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল কেন?
কারন হচ্ছে, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কারনে প্রতি
বছরই এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি
পাচ্ছে। ফলে উচ্চশিক্ষার জন্য দেশে হাতে গোনা কয়েকটি পাবলিক
বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন সংখ্যার স্বল্পতার কারণে প্রতি বছরই বিপুল সংখ্যক
ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হতে না পেরে অনেক প্রতিভাই কালের স্রোতে হারিয়ে
যাচ্ছিল। যার কারনে দেশে একটা অর্ধশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর চাপ বেড়ে গিয়ে
বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছিল। সরকার এসব বিবেচনা করেই ১৯৯২ সালে বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাশ করে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৯২ এবং সংশোধিত ১৯৯৮ এর আওতায় এ যাবত ৫৪ মতান্তরে ৫৬টি বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকার
বেসরকারিভাবে অনুমোদন দিয়েছে।
অনুমোদন দেয়ার দেড় যুগের মাথায় এসে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম প্রশ্নের মুখে পড়েছে। সরকার এবং ইউজিসি বারবারই এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম, মানসমপন্ন শিক্ষা প্রদান না করা, পর্যাপ্ত অবকাঠামো না থাকা, মানসমপন্ন পর্যাপ্ত পূর্ণকালীন শিক্ষকের অভাব, খন্ডকালীন শিক্ষকের আধিক্য, টিউশন ফি অনুযায়ী শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে যুগপোযুগী বেতন না দেয়া, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষক দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত একটা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান, ভাড়া বাড়িতে, হোটেলে, মার্কেটের উপরে, গার্মেন্টস এর উপরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনা, অপর্যাপ্ত লাইব্রেরী, ল্যাবরেটরী, দূর্ণীতির পাশাপাশি সরকারের অনুমোদন ব্যতিত যেখানে সেখানে ছোট ছোট মুদী দোকানের মত কেন্দ্র ও ক্যাম্পাস চালু করে সনদ বানিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে বলে দাবী করে আসছে। অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্বিবদ্যালয়সমূহ এ দাবীকে অস্বীকার করে আসছে। সরকার একদিকে এসব বলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে দোষারোপ করছে, আর বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ এর প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ না করে তাদের বানিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সরকার বা ইউজিসি কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করছেনা। এটাকে এভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে যে, সরকার, ইউজিসি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটা সুনিবিড় এবং আপোস রফার মাধ্যমে বানিজ্য চলছে। সরকার কেন এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না? শুধু মুখে বলার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে পরোক্ষভাবে তাদেরকে দূর্ণীতি ও সনদ বানিজ্যে উৎসাহিত করছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারন আছে। তবে সরকার এটা বলছে যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৯২ (সংশোধিত ১৯৯৮)-এ তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহনের কোন বিধান না থাকায় এ যাবৎ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। কিন্তু নতুন পাশ করা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ এ সে ব্যবস্থা কী রাখা হয়েছে? তাদের বিরুদ্ধে কী কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হবে? এ ব্যাপারে পরবর্তী পর্বে আলোচনা করা হবে।
১/১১ এর পর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে কয়েকটি ভাল কাজ করেছিল, তন্মধ্যে প্রথমটি ছিল ভোটার আইডি কার্ড প্রদানের মাধ্যমে যার ভোট তার নিজে দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা, যেটা প্রমাণিত হয়েছে। আর দ্বিতীয়টি ছিল ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে সকল অবৈধ আউটার ক্যাম্পাস ও কেন্দ্রে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি বন্ধ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০০৮ এর একটা খসড়া তৈরি করা। এ ব্যাপারেও তারা সফল হয়েছিল। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ভর্তি বানিজ্য বন্ধের প্রক্রিয়া হিসাবে সকল অবৈধ আউটার ক্যাম্পাস ও কেন্দ্রে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধের ব্যবস্থা করেছিল, কিন্তু বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহনের পরে ২০০৮ সালের সেই খসড়া আইনটিকে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে ১৮ জুলাই ২০১০ তারিখে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ নামে একটা আইন! তৈরি করে তাদের সনদ বানিজ্যের পথকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এ আইন পাশের পর এর দ্বারা কোন ছাত্র-ছাত্রীই উপকৃত হয়নি, আর হবেও না কোন কালে। উপরন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আরো দূর্ণীতিতে আকন্ঠ নিমজ্জিত হয়েছে এবং হচ্ছে ও হবে। যদি আইনটি কঠোর বা শিক্ষাবান্ধব হতো তবে আইনটি পাশের পর শতাধিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনের আবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা পড়তোনা। শিক্ষা ব্যবসায়ীরা এ ব্যবসা থেকে দূরে থাকতো। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আইনটি ব্যবসা বান্ধব হয়েছে। তাই নতুন আবেদনের এ হিরিক। এ আইন পাশ হবার পর অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অদ্যাবধি কোন সার্ভিস রুল, বেতন কাঠামো, ফি কাঠামো তৈরি করে ইউজিসিতে পাঠানো হয়নি। এমনকি বর্তমান সরকারের খসরা আইনে যে কয়টি ধারায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিয়ন্ত্রনে একটা চাপ সৃষ্টির ব্যবস্থা ছিল-সংসদীয় যাচাই বাছাই কমিটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির ম্যানেজ নামক তাবিজের কল্যাণে সেটুকুও বাতিল করে দিয়ে দূর্ণীতির পথকে সূগম করে দিয়েছে। সমিতি সরকার ও কমিটিকে চাপ সৃষ্টি করে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য একটা নাজায়েজ আইন নিজেদের বানিজ্যের বেসাতি প্রসারিত করার জন্য পাশ করিয়ে নিয়েছে। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও তাদের সমিতি বলছে যে, এটা শিক্ষাবান্ধব হলেও কিছু ধারা সংযোজন করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অস্তিত্বকে হুমকীর মুখে ঠেলে দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, এ আইনটি শিক্ষাবান্ধবতো হয়ইনি, বরং ব্যবসাবান্ধব হয়েছে বলে এর পর্যালোচনায় প্রমাণিত হয়েছে, যা পরবর্তীতে আলোচনায় আসবে।
২০১০ এর খসড়া আইন তৈরির পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠন এপিইউবি এবং কোন কোন মালিকপক্ষ তথাকথিত সুশীল সমাজের কিছু লোককে টাকা-পয়সা দিয়ে লাগিয়ে দিয়েছিল এ খসড়া আইনের অপব্যাখ্যা দিয়ে এটাকে পাশ না করার জন্য। পাশাপাশি নিজেরাও আইনটি পাশ না করার জন্য জোড় তদবির এবং লবিং চালিয়ে যেতে থাকলো এবং অবশেষে আইনটির সংসদীয় যাচাই-বাছাই কমিটি ম্যানেজ হয়ে গেল এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও তাদের সমিতি এক্ষেত্রে কিন্তু সুশীলদের দ্বারা লাভবান হয়েছে। তথাকথিত এ সুশীল সমাজ বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকায় প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে এ কথাটি বারবারই বলার চেষ্টা করেছেন যে, এ আইনটি পাশ হলে দেশে শিক্ষা সংকট সৃষ্টি হবে। ছাত্র-ছাত্রীদের উচ্চশিক্ষা বন্ধ হয়ে যাবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় না থাকলে দেশের মেধাবীরা বিদেশে চলে যাবে, মেধা পাচার হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রকৃতপক্ষে, মেধাবীরা এবং যাদের টাকা পয়সা আছে তারাই কেবলমাত্র উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য বিদেশে গমন করে থাকে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালু হবার পূর্বে বলতে গেলে তেমন কোন ছাত্র-ছাত্রীই আন্ডার গ্রাজুয়েশন, গ্রাজুয়েশন কিংবা পোস্ট গ্রাজুয়েশনের জন্য বিদেশের কোন বিশ্বিবদ্যালয়ে অধ্যয়নের জন্য যায়নি। কারন বাংলাদেশে প্রচলিত কোন বিষয়ের উপর (বাংলা, ইসলামিক স্টাডিজ, সমাজ বিজ্ঞান, সমাজ কল্যান, রাস্ট্রবিজ্ঞান ইত্যাদি) আন্ডার গ্রাজুয়েশন কিংবা গ্রাজুয়েশনের ডিগ্রী দেবার মত কোন বিষয় বিদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনকালেই ছিলনা, কেবলমাত্র ভারতের আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া। আজকাল দেশে শতাধিক বেসরকারি বিশ্বিবদ্যালয় থাকার পরও ছাত্র-ছাত্রী কিংবা অভিভাবকরা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে বা পড়াতে ভরসা পাচ্ছেনা। কারন দেশের বেসরকারি বিশ্বিবদ্যালয়গুলোতে বাজার চাহিদানুযায়ী যেসব বিষয় (যেমন-বিবিএ/বিবিএস, এমবিএ/এমবিএস, কমপিউটার সায়েন্স, ল', ইত্যাদি) চালু আছে, তার প্রায় সবই বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান এবং সেখানে বাংলাদেশের চেয়ে কম খরচে ডিগ্রী নিতে পারে। কারন বাংলাদেশের কোন কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ-তে অনার্স সমপন্ন করতে ৭-৮ লাখ টাকা টিউশন ফি প্রয়োজন হয় এবং একজন ছাত্রের ঢাকা শহরে খাওয়া, থাকা, পকেট খরচ, যাতায়াত, বইপত্র, স্টেশনারি ইত্যাদি বাবদ চার বছরে প্রয়োজন হয় আরো প্রায় ৫-৬ লাখ টাকা, সাকুল্যে প্রায় ১৩-১৪ লাখ টাকা। প্রশ্ন হচ্ছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন আসন স্বল্পতা ছিলনা, মেধাবীরা তখনো বিদেশে পড়তে গিয়েছে এবং দেশে ৫৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থাকার পরও হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী প্রতি বছরই উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। তাদেরকে ঠেকানো যাচ্ছেনা। কারন, তাদেরকে ঠেকাবার মত কোন মন্ত্র বর্তমানে দেশের সরকারি বা বেসরকারি কোন বিশ্ববিদ্যালয়েরই নেই। এদেশে যে মানের শিক্ষা প্রদান করা হয়, তার উপর অনেক অভিভাবকই ভরসা করতে পারেনা। এমনকি ছাত্র-ছাত্রীরাও ভরসা পাচ্ছেনা। তাইতো তারা দেধারছে বিদেশে চলে যাচ্ছে। তাই বিদেশে চলে যাবার ভয় দেখিয়ে আজ আর কোন লাভ নেই। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানই যেখানে বর্তমানে প্রশ্নের মুখে পড়েছে, সেখানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানের কথা বলে কি লাভ?
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের খন্ডকালীন শিক্ষকদের একটা বড় অংশ হচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণকালীন শিক্ষক। বলা যায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চলছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপর ভরসা করে। আর এ সুযোগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন কোন শিক্ষক একেকটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩-৪টি কোর্সে পাঠদান করে থাকেন। এভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন কোন শিক্ষক কমপক্ষে ৩-৪টি থেকে ৭-৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও খন্ডকালীনে পাঠদান করে থাকেন। এর ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা ঠকছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা না পারছেন ঘর সামলাতে, না পারছেন পর সামলাতে। ফলে সরকারি-বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানই ব্যহত হচ্ছে। এতে করে মেধাবীদের মেধা বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ মেধাশুণ্য জাতি দিয়ে ভবিষ্যত কতটা আলোকিত হবে, তা ভাবার সময় কি এখনো হয়নি? লাভের মধ্যে যা হচ্ছে, তা হলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে সাথে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব শিক্ষকরাও প্রতি মাসে লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করে রাতারাতি কেউ কেউ কোটিপতিও বনে গেছেন। এখন তারাও নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় খুলে সনদ ব্যবসার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন। তাদের কাছে প্রশ্ন হচ্ছে, তারা এতে কী খুশী? তারা (এসব শিক্ষকরা) তাদের বিবেকের কাছে এ প্রশ্নটা কখনো কি করেছেন?
মেধাশুন্য প্রশাসন!: ২০ জুলাই ২০১১ তারিখের দৈনিক মানবজমিনে প্রকাশিত প্রথম পাতার দ্বিতীয় হেডলাইনের খবর ছিল “মেধাশুন্য প্রশাসন, ইংরেজি ড্রাফট করতে কনসালট্যান্ট ভাড়া”। ঐ রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে ইংরেজি জানা কর্মকর্তাদের খুজে পাওয়া দুস্কর। তাই সরকারের অর্থায়ন চুক্তি বা অন্য যে কোন চুক্তির ড্রাফট তৈরি করে পাঠাচ্ছে উন্নয়ন সহযোগীরাই। অনেক ক্ষেত্রে মোটা অংকের অর্থ খরচ করে কনসালট্যান্ট ভাড়া করে তাদের কাছ থেকে ড্রাফট তৈরি করে নিতে হচ্ছে। ফলে আইনটির খসড়া নিয়েও অন্ধকারে থাকেন কর্মকর্তারা। প্রতিবেদনে আরও প্রকাশ, কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ইংরেজি রয়েছে এমন কোন কাজ থাকলে কর্মকর্তারা পরদিন ছুটিতে থাকছেন, কেউবা অসুস্থ্যতার দোহাই দিয়ে কাজ এড়িয়ে যাচ্ছেন। আরো একটি খবরের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষন করতে চাই। খবরটি ছাপা হয়েছে ৩০ জুলাই ২০১১ তারিখের দৈনিক জনকন্ঠের প্রথম পাতায়। শিরোনাম ছিল হেলথ প্রোভাইডার প্রার্থী ৯২ জনের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ভূয়া। খবরের মধ্যে হেলথ প্রোভাইডার পদের দিকে সকলের দৃষ্টি ফেরানো যাক। হেলথ প্রোভাইডার এর সহজ অর্থ স্বাস্থ্য সরবরাহকারী অথবা প্রদানকারী। প্রশ্ন হচ্ছে, স্বাস্থ্য কি কেউ সরবরাহ বা প্রদান করে? হতে পারে স্বাস্থ্য সেবা সরবরাহকারী বা স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী। পদ সৃষ্টি ও এর নামকরণের একটা নমুনা হচ্ছে এটা। এ হচ্ছে আমাদের মেধাবী প্রশাসন। এ হচ্ছে একটা জাতির কান্ডারী (প্রশাসন)! আরো একটি খবরের দিকে দৃষ্টি দেয়া যেতে পারে। খবরটি ছাপা হয়েছে দৈনিক যুগান্তরে । শিরোনাম ছিল: "যোগ্য সচিব সংকটে প্রশাসন বড় সমস্যা দলবাজি দু'দশকে অযোগ্যরাই পদোন্নতি পেয়ে উপরে উঠে এসেছে"। বিস্তারিতে বলা হয়েছে, প্রশাসনে যোগ্য সচিব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। খবরটি শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও কয়েক বছর ধরে বাস্তব অবস্থা এমনই পর্যায়ে পৌচেছে। যে কারণে বিশেষ প্রয়োজনে গত কয়েক মাসে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে পরিবর্তন আনতে চাইলেও শেষ মুহুর্তে এসে তা সম্ভব হয়নি। এজন্য রদবদল সম্ভাব্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোতে দায়িত্ব পালনে সেরকম সক্ষম সচিব তালাশ করা হচ্ছে। খবরে আরো বলা হয়েছে, পদোন্নতি পাওয়ার পরে তিনি যে পদে দায়িত্ব পালন করবেন সে পদের দায়িত্ব পালনে বাস্তবে তার কতটুকু দক্ষতা, যোগ্যতা ও লেখাপড়া আছে তা তারা বিবেচনায় আনতে চান না। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো প্রশাসনে যে কর্মকর্তা দূর্ণীতি ও দলবাজিতে যত বেশি দক্ষ, তিনি পদোন্নতি পাওয়ার জন্য নিজেকে তত বেশি যোগ্য মনে করেন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাস্তবে গত প্রায় দু'দশকে এ ধরনের কর্মকর্তারাই বেশি সংখ্যায় পদোন্নতি পেয়ে উপরে উঠে এসেছেন। এজন্যই এখন ভালমানের সচিব পাওয়া যাচ্ছেনা। এখানে যে কথাটি বলা হয়নি, তা হলো শুধুমাত্র দলবাজির কারণে যত সংখ্যক না পদোন্নতিই দেয়া হয়েছে, তার চেয়ে কয়েকশতগুণ বেশি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নিজেদের রাজনৈতিক, ব্যক্তিগত হীন স্বার্থসিদ্ধির জন্য অযোগ্যদেরকেই বেশি মাত্রায় নিয়োগ দিয়েছে। বলা যায় '৭৫ পরবর্তী সকল সরকারই এ কাজটি করেছে। বিশেষ করে '৭৫ পূর্ববর্তী ব্যাচের কোন কর্মকর্তাই সম্ভবত: আর চাকুরীতে নেই। সবাই অবসরে চলে গেছেন। কাজেই সমস্যা তৈরি করা হয়েছে '৭৫ পরবর্তীতেই। এখনতো নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক বিবেচনাটা খোলামেলাভাবেই করা হচ্ছে। কাজেই আমাদের ভবিষ্যত যে ক্রমান্বয়ে অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে আর কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। আর যেহেতু অযোগ্যরাই নিয়োগ ও পদোন্নতি পেয়েছে, তাই দূর্ণীতিতো হবেই।ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফর এবং এ সময়ে সংঘটিত ঘটনাসমূহ থেকে আমাদের প্রশাসনের দক্ষতার বিষয়টি একেবারে জলের মত পরিস্কার হয়ে গেছে। গত ২১ সেপ্টেম্বর ২০১১ তারিখের দৈনিক আমাদের সময়ের একটা ছোট সংবাদ ছিল এরকম: প্রশাসনকে আরো গতিশীল করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের জন্য আরো ৮ মূখ্য সচিবের পদ সৃষ্টি। যেখানে দক্ষ ও যোগ্যতা সম্পন্ন আমলার অভাব তীব্রতর, সেখানে এসব অদক্ষ ও অযোগ্যদেরকে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে মূখ্য সচিব নিয়োগ দিয়ে কী হবে?
অনুমোদন দেয়ার দেড় যুগের মাথায় এসে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম প্রশ্নের মুখে পড়েছে। সরকার এবং ইউজিসি বারবারই এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম, মানসমপন্ন শিক্ষা প্রদান না করা, পর্যাপ্ত অবকাঠামো না থাকা, মানসমপন্ন পর্যাপ্ত পূর্ণকালীন শিক্ষকের অভাব, খন্ডকালীন শিক্ষকের আধিক্য, টিউশন ফি অনুযায়ী শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে যুগপোযুগী বেতন না দেয়া, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষক দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত একটা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান, ভাড়া বাড়িতে, হোটেলে, মার্কেটের উপরে, গার্মেন্টস এর উপরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনা, অপর্যাপ্ত লাইব্রেরী, ল্যাবরেটরী, দূর্ণীতির পাশাপাশি সরকারের অনুমোদন ব্যতিত যেখানে সেখানে ছোট ছোট মুদী দোকানের মত কেন্দ্র ও ক্যাম্পাস চালু করে সনদ বানিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে বলে দাবী করে আসছে। অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্বিবদ্যালয়সমূহ এ দাবীকে অস্বীকার করে আসছে। সরকার একদিকে এসব বলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে দোষারোপ করছে, আর বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ এর প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ না করে তাদের বানিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সরকার বা ইউজিসি কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করছেনা। এটাকে এভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে যে, সরকার, ইউজিসি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটা সুনিবিড় এবং আপোস রফার মাধ্যমে বানিজ্য চলছে। সরকার কেন এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না? শুধু মুখে বলার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে পরোক্ষভাবে তাদেরকে দূর্ণীতি ও সনদ বানিজ্যে উৎসাহিত করছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারন আছে। তবে সরকার এটা বলছে যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৯২ (সংশোধিত ১৯৯৮)-এ তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহনের কোন বিধান না থাকায় এ যাবৎ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। কিন্তু নতুন পাশ করা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ এ সে ব্যবস্থা কী রাখা হয়েছে? তাদের বিরুদ্ধে কী কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হবে? এ ব্যাপারে পরবর্তী পর্বে আলোচনা করা হবে।
১/১১ এর পর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে কয়েকটি ভাল কাজ করেছিল, তন্মধ্যে প্রথমটি ছিল ভোটার আইডি কার্ড প্রদানের মাধ্যমে যার ভোট তার নিজে দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা, যেটা প্রমাণিত হয়েছে। আর দ্বিতীয়টি ছিল ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে সকল অবৈধ আউটার ক্যাম্পাস ও কেন্দ্রে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি বন্ধ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০০৮ এর একটা খসড়া তৈরি করা। এ ব্যাপারেও তারা সফল হয়েছিল। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ভর্তি বানিজ্য বন্ধের প্রক্রিয়া হিসাবে সকল অবৈধ আউটার ক্যাম্পাস ও কেন্দ্রে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধের ব্যবস্থা করেছিল, কিন্তু বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহনের পরে ২০০৮ সালের সেই খসড়া আইনটিকে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে ১৮ জুলাই ২০১০ তারিখে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ নামে একটা আইন! তৈরি করে তাদের সনদ বানিজ্যের পথকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এ আইন পাশের পর এর দ্বারা কোন ছাত্র-ছাত্রীই উপকৃত হয়নি, আর হবেও না কোন কালে। উপরন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আরো দূর্ণীতিতে আকন্ঠ নিমজ্জিত হয়েছে এবং হচ্ছে ও হবে। যদি আইনটি কঠোর বা শিক্ষাবান্ধব হতো তবে আইনটি পাশের পর শতাধিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনের আবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা পড়তোনা। শিক্ষা ব্যবসায়ীরা এ ব্যবসা থেকে দূরে থাকতো। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আইনটি ব্যবসা বান্ধব হয়েছে। তাই নতুন আবেদনের এ হিরিক। এ আইন পাশ হবার পর অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অদ্যাবধি কোন সার্ভিস রুল, বেতন কাঠামো, ফি কাঠামো তৈরি করে ইউজিসিতে পাঠানো হয়নি। এমনকি বর্তমান সরকারের খসরা আইনে যে কয়টি ধারায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিয়ন্ত্রনে একটা চাপ সৃষ্টির ব্যবস্থা ছিল-সংসদীয় যাচাই বাছাই কমিটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির ম্যানেজ নামক তাবিজের কল্যাণে সেটুকুও বাতিল করে দিয়ে দূর্ণীতির পথকে সূগম করে দিয়েছে। সমিতি সরকার ও কমিটিকে চাপ সৃষ্টি করে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য একটা নাজায়েজ আইন নিজেদের বানিজ্যের বেসাতি প্রসারিত করার জন্য পাশ করিয়ে নিয়েছে। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও তাদের সমিতি বলছে যে, এটা শিক্ষাবান্ধব হলেও কিছু ধারা সংযোজন করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অস্তিত্বকে হুমকীর মুখে ঠেলে দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, এ আইনটি শিক্ষাবান্ধবতো হয়ইনি, বরং ব্যবসাবান্ধব হয়েছে বলে এর পর্যালোচনায় প্রমাণিত হয়েছে, যা পরবর্তীতে আলোচনায় আসবে।
২০১০ এর খসড়া আইন তৈরির পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠন এপিইউবি এবং কোন কোন মালিকপক্ষ তথাকথিত সুশীল সমাজের কিছু লোককে টাকা-পয়সা দিয়ে লাগিয়ে দিয়েছিল এ খসড়া আইনের অপব্যাখ্যা দিয়ে এটাকে পাশ না করার জন্য। পাশাপাশি নিজেরাও আইনটি পাশ না করার জন্য জোড় তদবির এবং লবিং চালিয়ে যেতে থাকলো এবং অবশেষে আইনটির সংসদীয় যাচাই-বাছাই কমিটি ম্যানেজ হয়ে গেল এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও তাদের সমিতি এক্ষেত্রে কিন্তু সুশীলদের দ্বারা লাভবান হয়েছে। তথাকথিত এ সুশীল সমাজ বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকায় প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে এ কথাটি বারবারই বলার চেষ্টা করেছেন যে, এ আইনটি পাশ হলে দেশে শিক্ষা সংকট সৃষ্টি হবে। ছাত্র-ছাত্রীদের উচ্চশিক্ষা বন্ধ হয়ে যাবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় না থাকলে দেশের মেধাবীরা বিদেশে চলে যাবে, মেধা পাচার হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রকৃতপক্ষে, মেধাবীরা এবং যাদের টাকা পয়সা আছে তারাই কেবলমাত্র উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য বিদেশে গমন করে থাকে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালু হবার পূর্বে বলতে গেলে তেমন কোন ছাত্র-ছাত্রীই আন্ডার গ্রাজুয়েশন, গ্রাজুয়েশন কিংবা পোস্ট গ্রাজুয়েশনের জন্য বিদেশের কোন বিশ্বিবদ্যালয়ে অধ্যয়নের জন্য যায়নি। কারন বাংলাদেশে প্রচলিত কোন বিষয়ের উপর (বাংলা, ইসলামিক স্টাডিজ, সমাজ বিজ্ঞান, সমাজ কল্যান, রাস্ট্রবিজ্ঞান ইত্যাদি) আন্ডার গ্রাজুয়েশন কিংবা গ্রাজুয়েশনের ডিগ্রী দেবার মত কোন বিষয় বিদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনকালেই ছিলনা, কেবলমাত্র ভারতের আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া। আজকাল দেশে শতাধিক বেসরকারি বিশ্বিবদ্যালয় থাকার পরও ছাত্র-ছাত্রী কিংবা অভিভাবকরা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে বা পড়াতে ভরসা পাচ্ছেনা। কারন দেশের বেসরকারি বিশ্বিবদ্যালয়গুলোতে বাজার চাহিদানুযায়ী যেসব বিষয় (যেমন-বিবিএ/বিবিএস, এমবিএ/এমবিএস, কমপিউটার সায়েন্স, ল', ইত্যাদি) চালু আছে, তার প্রায় সবই বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান এবং সেখানে বাংলাদেশের চেয়ে কম খরচে ডিগ্রী নিতে পারে। কারন বাংলাদেশের কোন কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ-তে অনার্স সমপন্ন করতে ৭-৮ লাখ টাকা টিউশন ফি প্রয়োজন হয় এবং একজন ছাত্রের ঢাকা শহরে খাওয়া, থাকা, পকেট খরচ, যাতায়াত, বইপত্র, স্টেশনারি ইত্যাদি বাবদ চার বছরে প্রয়োজন হয় আরো প্রায় ৫-৬ লাখ টাকা, সাকুল্যে প্রায় ১৩-১৪ লাখ টাকা। প্রশ্ন হচ্ছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন আসন স্বল্পতা ছিলনা, মেধাবীরা তখনো বিদেশে পড়তে গিয়েছে এবং দেশে ৫৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থাকার পরও হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী প্রতি বছরই উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। তাদেরকে ঠেকানো যাচ্ছেনা। কারন, তাদেরকে ঠেকাবার মত কোন মন্ত্র বর্তমানে দেশের সরকারি বা বেসরকারি কোন বিশ্ববিদ্যালয়েরই নেই। এদেশে যে মানের শিক্ষা প্রদান করা হয়, তার উপর অনেক অভিভাবকই ভরসা করতে পারেনা। এমনকি ছাত্র-ছাত্রীরাও ভরসা পাচ্ছেনা। তাইতো তারা দেধারছে বিদেশে চলে যাচ্ছে। তাই বিদেশে চলে যাবার ভয় দেখিয়ে আজ আর কোন লাভ নেই। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানই যেখানে বর্তমানে প্রশ্নের মুখে পড়েছে, সেখানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানের কথা বলে কি লাভ?
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের খন্ডকালীন শিক্ষকদের একটা বড় অংশ হচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণকালীন শিক্ষক। বলা যায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চলছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপর ভরসা করে। আর এ সুযোগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন কোন শিক্ষক একেকটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩-৪টি কোর্সে পাঠদান করে থাকেন। এভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন কোন শিক্ষক কমপক্ষে ৩-৪টি থেকে ৭-৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও খন্ডকালীনে পাঠদান করে থাকেন। এর ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা ঠকছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা না পারছেন ঘর সামলাতে, না পারছেন পর সামলাতে। ফলে সরকারি-বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানই ব্যহত হচ্ছে। এতে করে মেধাবীদের মেধা বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ মেধাশুণ্য জাতি দিয়ে ভবিষ্যত কতটা আলোকিত হবে, তা ভাবার সময় কি এখনো হয়নি? লাভের মধ্যে যা হচ্ছে, তা হলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে সাথে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব শিক্ষকরাও প্রতি মাসে লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করে রাতারাতি কেউ কেউ কোটিপতিও বনে গেছেন। এখন তারাও নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় খুলে সনদ ব্যবসার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন। তাদের কাছে প্রশ্ন হচ্ছে, তারা এতে কী খুশী? তারা (এসব শিক্ষকরা) তাদের বিবেকের কাছে এ প্রশ্নটা কখনো কি করেছেন?
মেধাশুন্য প্রশাসন!: ২০ জুলাই ২০১১ তারিখের দৈনিক মানবজমিনে প্রকাশিত প্রথম পাতার দ্বিতীয় হেডলাইনের খবর ছিল “মেধাশুন্য প্রশাসন, ইংরেজি ড্রাফট করতে কনসালট্যান্ট ভাড়া”। ঐ রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে ইংরেজি জানা কর্মকর্তাদের খুজে পাওয়া দুস্কর। তাই সরকারের অর্থায়ন চুক্তি বা অন্য যে কোন চুক্তির ড্রাফট তৈরি করে পাঠাচ্ছে উন্নয়ন সহযোগীরাই। অনেক ক্ষেত্রে মোটা অংকের অর্থ খরচ করে কনসালট্যান্ট ভাড়া করে তাদের কাছ থেকে ড্রাফট তৈরি করে নিতে হচ্ছে। ফলে আইনটির খসড়া নিয়েও অন্ধকারে থাকেন কর্মকর্তারা। প্রতিবেদনে আরও প্রকাশ, কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ইংরেজি রয়েছে এমন কোন কাজ থাকলে কর্মকর্তারা পরদিন ছুটিতে থাকছেন, কেউবা অসুস্থ্যতার দোহাই দিয়ে কাজ এড়িয়ে যাচ্ছেন। আরো একটি খবরের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষন করতে চাই। খবরটি ছাপা হয়েছে ৩০ জুলাই ২০১১ তারিখের দৈনিক জনকন্ঠের প্রথম পাতায়। শিরোনাম ছিল হেলথ প্রোভাইডার প্রার্থী ৯২ জনের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ভূয়া। খবরের মধ্যে হেলথ প্রোভাইডার পদের দিকে সকলের দৃষ্টি ফেরানো যাক। হেলথ প্রোভাইডার এর সহজ অর্থ স্বাস্থ্য সরবরাহকারী অথবা প্রদানকারী। প্রশ্ন হচ্ছে, স্বাস্থ্য কি কেউ সরবরাহ বা প্রদান করে? হতে পারে স্বাস্থ্য সেবা সরবরাহকারী বা স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী। পদ সৃষ্টি ও এর নামকরণের একটা নমুনা হচ্ছে এটা। এ হচ্ছে আমাদের মেধাবী প্রশাসন। এ হচ্ছে একটা জাতির কান্ডারী (প্রশাসন)! আরো একটি খবরের দিকে দৃষ্টি দেয়া যেতে পারে। খবরটি ছাপা হয়েছে দৈনিক যুগান্তরে । শিরোনাম ছিল: "যোগ্য সচিব সংকটে প্রশাসন বড় সমস্যা দলবাজি দু'দশকে অযোগ্যরাই পদোন্নতি পেয়ে উপরে উঠে এসেছে"। বিস্তারিতে বলা হয়েছে, প্রশাসনে যোগ্য সচিব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। খবরটি শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও কয়েক বছর ধরে বাস্তব অবস্থা এমনই পর্যায়ে পৌচেছে। যে কারণে বিশেষ প্রয়োজনে গত কয়েক মাসে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে পরিবর্তন আনতে চাইলেও শেষ মুহুর্তে এসে তা সম্ভব হয়নি। এজন্য রদবদল সম্ভাব্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোতে দায়িত্ব পালনে সেরকম সক্ষম সচিব তালাশ করা হচ্ছে। খবরে আরো বলা হয়েছে, পদোন্নতি পাওয়ার পরে তিনি যে পদে দায়িত্ব পালন করবেন সে পদের দায়িত্ব পালনে বাস্তবে তার কতটুকু দক্ষতা, যোগ্যতা ও লেখাপড়া আছে তা তারা বিবেচনায় আনতে চান না। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো প্রশাসনে যে কর্মকর্তা দূর্ণীতি ও দলবাজিতে যত বেশি দক্ষ, তিনি পদোন্নতি পাওয়ার জন্য নিজেকে তত বেশি যোগ্য মনে করেন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাস্তবে গত প্রায় দু'দশকে এ ধরনের কর্মকর্তারাই বেশি সংখ্যায় পদোন্নতি পেয়ে উপরে উঠে এসেছেন। এজন্যই এখন ভালমানের সচিব পাওয়া যাচ্ছেনা। এখানে যে কথাটি বলা হয়নি, তা হলো শুধুমাত্র দলবাজির কারণে যত সংখ্যক না পদোন্নতিই দেয়া হয়েছে, তার চেয়ে কয়েকশতগুণ বেশি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নিজেদের রাজনৈতিক, ব্যক্তিগত হীন স্বার্থসিদ্ধির জন্য অযোগ্যদেরকেই বেশি মাত্রায় নিয়োগ দিয়েছে। বলা যায় '৭৫ পরবর্তী সকল সরকারই এ কাজটি করেছে। বিশেষ করে '৭৫ পূর্ববর্তী ব্যাচের কোন কর্মকর্তাই সম্ভবত: আর চাকুরীতে নেই। সবাই অবসরে চলে গেছেন। কাজেই সমস্যা তৈরি করা হয়েছে '৭৫ পরবর্তীতেই। এখনতো নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক বিবেচনাটা খোলামেলাভাবেই করা হচ্ছে। কাজেই আমাদের ভবিষ্যত যে ক্রমান্বয়ে অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে আর কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। আর যেহেতু অযোগ্যরাই নিয়োগ ও পদোন্নতি পেয়েছে, তাই দূর্ণীতিতো হবেই।ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফর এবং এ সময়ে সংঘটিত ঘটনাসমূহ থেকে আমাদের প্রশাসনের দক্ষতার বিষয়টি একেবারে জলের মত পরিস্কার হয়ে গেছে। গত ২১ সেপ্টেম্বর ২০১১ তারিখের দৈনিক আমাদের সময়ের একটা ছোট সংবাদ ছিল এরকম: প্রশাসনকে আরো গতিশীল করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের জন্য আরো ৮ মূখ্য সচিবের পদ সৃষ্টি। যেখানে দক্ষ ও যোগ্যতা সম্পন্ন আমলার অভাব তীব্রতর, সেখানে এসব অদক্ষ ও অযোগ্যদেরকে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে মূখ্য সচিব নিয়োগ দিয়ে কী হবে?
আমি ঐ সংবাদ প্রতিবেদনগুলোর বিস্তারিতে যাবনা। শুধু কেন এবং কীভাবে এসব অদক্ষ ও অযোগ্য প্রশাসন গড়ে উঠেছে-এর কারনটা খুজতে চাই। এর অনেক কারন, তার মধ্যে অন্যতম একটি কারন হচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের লাগামহীনভাবে টাকার পিছনে ছোটা।
এক
একজন শিক্ষককে ৫-৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খন্ডকালীন শিক্ষকতা করা। যার
ফলে তারা না পারছে মুল কর্মস্থলে মনযোগ দিতে, না পারছে খন্ডকালীনে মনযোগ
দিতে। এ কারনেই শিক্ষার্থীরা কিছুই শিখতে না পারার ফলে বর্তমানে
পাবলিক-প্রাইভেট সর্বস্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি বছর একটা বিরাট
সংখ্যক শিক্ষার্থী মেধাশুন্য হয়ে শুধু সনদ নিয়ে বেড়িয়ে পড়ছে। প্রশাসন
ক্যাডারে যাদেরকে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে, তারা দেশের সেরা ও মেধাবী মুখ হিসাবেই
পরিচিত। কারন তাদেরকে এ ক্যাডার সার্ভিসে যোগ দিতে অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে
আসতে হয়েছে। এ চড়াই উতরাই পেরিয়ে যাবার মাঝখানে থাকে পিএসসি (পাবলিক
সার্ভিস কমিশন) নামক একটা ... ... ... প্রতিষ্ঠান। পাবলিক সার্ভিস কমিশনই
লক্ষ লক্ষ মেধাবীদের মাঝখান থেকে এসব মেধাশুণ্যদেরকে নির্বাচন করে থাকে।
স্বাভাবিকভাবেই এসব মেধাশুণ্যদেরকে যারা নিয়োগ দিয়ে থাকে, তাদের মেধা নিয়েই
এখন প্রশ্ন জাগাটা স্বাভাবিক। নিয়োগকর্তাদের মেধাই যদি থাকতো তবে
প্রশাসনকে নিয়ে আজ এরকম সংবাদ ছাপা হবার কথা নয়।
দেশে যদি একটাও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় না থাকে, তথাপি কোন সমস্যা হবেনা, যেমন আগে হয়নি। আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারলে যেমন তারা সরকারি বা বেসরকারি কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে পড়াশোনা করতো, এখনো তাই করবে। অন্তত: এতটুকু শান্তনা তাদের থাকবে যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে সনদ কেনার মত অপবাদ তাদের মাথা পেতে নিতে হবেনা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সব ছাত্র-ছাত্রীরাই খারাপ মানের তা কিন্তু নয়। অনেক মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরাও আজকাল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পেরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। অথচ তাদেরকেও ঢালাওভাবে সনদ কেনার মত অপবাদ মাথায় নিতে হচ্ছে। সনদ যে বিক্রি হয়না, তাতো নয়। ৫৪/৫৬ টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বছরে লক্ষাধিক সনদ যে বিক্রি হয়, এতে কোন সন্দেহ করার অবকাশ নেই। এমনও দেখা যাচ্ছে যে, কোন কোন ছাত্র-ছাত্রী এসএসসি ও এইচএসসিতে দ্বিতীয়/তৃতীয় বিভাগে পাশ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে অনার্স কিংবা মাস্টার্সে অনায়াসে প্রথম বিভাগ অথবা সিজিপিএ ৪.০০ এর মধ্যে ৪.০০ পাচ্ছে। এর ফল অবশ্য ভাল হচ্ছেনা। কারন চাকুরীর বাজারে প্রবেশ পথেই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে তাদেরকে যে, তাদের এরকম অপ্রত্যাশিত ফলাফলের মাজেজাটা কী?
বেসরকারি বিশবিদ্যালয়ের পক্ষে সাফাই গেয়ে যারা সনদ বানিজ্যকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করেছেন, তাদের কিছু লেখার উপর আলোকপাত করা হলো:
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আবদুল মান্নান: গত ২৭.০৫.২০১১ ইং তারিখে দৈনিক প্রথম আলো প্রত্রিকায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আবদুল মান্নান কর্তৃক 'ভাল বিশ্ববিদ্যালয় মন্দ বিশ্ববিদ্যালয়' শিরোনামে এক নিবন্ধে অনেক বিষয়েরই অবতারনা করেছেন। এখানে তার কিছু অংশ উল্লেখ করে কিছুটা যোগ, অনুযোগ, বিয়োগ করতে চাই।
(১) "বাংলাদেশে সামপ্রতিক কালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাধিক্যের কারণে অনেকেই শিক্ষক হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি নিয়ে ঢুকে পড়েছেন, যাঁদের ওই পর্যায়ে শিক্ষকতা করার তেমন কোনো যোগ্যতাই নেই। গত তিন দশকে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-উভয়ের সংখ্যা বেড়েছে ঠিক, তবে শিক্ষার মান কতটুকু বেড়েছে বা যা ছিল তা কতটুকু বজায় থেকেছে, এ নিয়ে এখন ভাবার সময় হয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স এখনো কম, সেহেতু এ মন্তব্য অনেকটা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এ মন্তব্যের আওতামুক্ত, তা কিন্তু নয়। কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও এমন অনেক শিক্ষক আছেন, যাঁদের এই পেশায় আসা উচিত হয়নি।
-তিনি যাদেরকে এ পেশায় আসা উচিৎ হয়নি বলেই তিনি কেন যেন একটু নিজেকে বাচিয়ে লেখার চেষ্টা করছেন, তাদের এ পেশায় আসার কোন যোগ্যতা প্রকৃতপক্ষেই নেই। কিন্ত তারা এসেছে। আমাদের জাতির জন্য এটা একটা লজ্জার বিষয় যে, আমাদের দেশে যারা ভাল বা মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী হিসাবে পরিচিত, তারা কেউ শিক্ষকতা পেশায় এখন আর আসতে চাচ্ছেন না। তারা ব্যাংক, বীমা, বহুজাতিক ও বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে এবং বিদেশে গিয়ে যে কোন পেশায় চাকুরী করছে দেধারছে। তার কারন একটাই শিক্ষকদের বেতনভাতা এতটাই কম যে, তা দ্বারা শিক্ষক হিসাবে তাদের মান-সম্মান বজায় রেখে জীবিকা নির্বাহ করা সম্ভব নয়, যদি তারা সৎভাবে জীবনযাপন করেন। যদিও সৎ শব্দটি আজকাল অভিধান থেকে বিতারিত প্রায়। এ শব্দটি বাচ্চাদের ব্যাকরণ বইতে বিপরিত শব্দ পড়ানোর মত একটা বিষয় ছাড়া এখন আর কিছুই নয়। আজকাল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন কোনটির বেতনভাতার পরিমান সন্তোষজনক, কিন্তু অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়েরই বেতনভাতার পরিমান এতটাই কম যে, এগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয় না বলে কোন কোচিং সেন্টার কিংবা কেজি স্কুল বলা যেতে পারে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জীবনযাত্রার মান এতটাই খারাপ যা বলার অপেক্ষা রাখেনা। দেশে বেকার সমসা এখন এতটাই প্রকট যে, যে যেখানে যেভাবে পারছে ঢুকে পরছে। পেট বাচাতে হবে। পরিবার বাচাতে হবে। কারন লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে অভিভাবকরা একটা নিরাপদ ভবিষ্যত রচনা করার জন্যইতো ছেলেমেয়েদেরকে পড়িয়েছেন। এখনই উদাহরন দিচ্ছিনা। পরবর্ততে উদাহরন দিয়ে দিব বলে আশা রাখি।
তিনি আরো লিখেছেন (২) "অনুজপ্রতিম সহকর্মী ও শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বছর কয়েক আগে অনেকটা আক্ষেপ করে প্রথম আলোয় লিখেছিলেন, অবস্থার উন্নতি না হলে দেশের অনেক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় একদিন হয়তো আদমজী পাটকলের মতো বন্ধ করে দিতে হবে। এর মধ্যে হয়তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও থাকবে। ........................ ড. জাফর ইকবাল আসলে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চরম হতাশাব্যঞ্জক অবস্থা দেখে এমন একটি মন্তব্য করেছিলেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান নিয়ে হরদম একশ্রেণীর গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ ও বিজ্ঞ আলোচক-বিশ্লেষকেরা বিভিন্ন ফোরাম মাতিয়ে রাখেন। কদাচিৎ তাঁরা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে মাথা ঘামান।
-কথাটার ভিতর কিছুটা সত্যতো আছেই। আমি এ লেখার গোড়ার দিকে এ কথা আগেও বলেছি যে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাইতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের খন্ডকালীন শিক্ষকদের একটা বড় অংশ। তাদের একেকজন শিক্ষক কমপক্ষে ৩-৪টি থেকে ৭-৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও ৩-৪টি করে কোর্সে পাঠদান করে থাকেন। এতে তার মূল দায়িত্ব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা ঠকছে। তারা না পারছে ঘর সামলাতে না পারছে পর সামলাতে। ফলে সরকারি-বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানই ব্যহত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে আদমজী পাটকলের মতো সরকারি-বেসরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই হয়তো একদিন বন্ধ করে দিতে হবে-শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়।
(২) যতই নিয়মিত বিরতি দিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ইটপাটকেল মারা হোক, একটি কথা সবাইকে মানতেই হবে, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ভালো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছে। এখানে প্রথমে যোগ্যতা অনুসারে প্রার্থীদের ছোট তালিকা করা হয়। এরপর তাঁদের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সিনিয়র শিক্ষকদের সামনে একটি ছোট সেমিনার দিতে হয়। তারপর মৌখিক পরীক্ষা হয় এবং তাঁকে যদি যোগ্য মনে করা হয়, তাহলে তাঁর প্রথম চুক্তি হয় এক বছরের জন্য। এই এক বছর (সাধারণত তিনটি সেমিস্টার) ছাত্র ও বিভাগীয় প্রধান বা কোনো কোনো সময় ডিন তাঁকে কেমন মূল্যায়ন করেন, তা দেখা হয় এবং সবকিছু যদি সন্তোষজনক হয় তাহলে তাঁর চুক্তি নবায়ন করা হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস মিস করা বা দেরিতে আসা অনেকটা অকল্পনীয়।
-এ বিষয়ে বলা যায় যে, তিনি যা বলেছেন তা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দু'চারটির বেলায় প্রযোজ্য হতে পারে, বাকীগুলোর অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে, তারা শিক্ষক নিয়োগের সময় প্রার্থীকে প্রথমেই প্রশ্ন করে বসেন, কত টাকা বেতন চান? ইন্টারভিউর প্রথম প্রশ্নটাই যদি হয় এরকম, তাহলে আর কি বলার আছে? যে প্রশ্নটি সবকিছুর শেষে আসার কথা, সেটাই যদি হয় প্রথম প্রশ্ন তাহলে মান্নান স্যার কি বলবেন এ ব্যাপারে? আমার ধারনা, তিনি হয়তো দু-একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ কমিটির এক্সটার্নাল ছিলেন, তাই তার এ ধারনা হতে পারে। কারন অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই এসব এক্সটার্নালদের সামনে এভাবেই অভিনয় করে থাকে। কোন কোন এক্সটার্নালদেরকে আবার খাম ধরিয়ে দিলেই হলো। তাদের উপস্থিতিরও প্রয়োজন হয়না। এটাই বাস্তবতা। আর চুক্তি নবায়ন এর বিষয়টি খুবই নগন্য। বেশিরভাগ শিক্ষককেই নবায়ন বা বছর শেষে বেতন বৃদ্ধির সময় এলেই তাদেরকে বিভিন্নভাবে আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেয়া হয় যে, তাদের আর প্রয়োজন নেই। তাই এসব শিক্ষকরা বাধ্য হয়ে চলে যাচ্ছেন, নয়তো মুচলেকা দিয়ে অবহেলিতভাবে রয়ে যাচ্ছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুন শিক্ষকদের এক একটা ট্রেনিং সেন্টার যেন। এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পাড়ি জমায়। আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আবার কম বেতনে নতুন মুখ নিয়োগ দেয়। এতে ক্ষতি হয় ছাত্র-ছাত্রীদের। তারা কোনকালেই অভিজ্ঞ শিক্ষকের কাছ থেকে বেশিদিন পাঠ গ্রহণ করতে পারেননা। তারা আবার নতুন শিক্ষক, নতুন করে পরিচয়, নতুন করে পড়ার স্টাইল ইত্যাদি রপ্ত করতে করতেই সেমিস্টার শেষ। এটাই হচ্ছে বাস্তব চিত্র।
(৩) কারও কারও একটি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় মানে তার অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের জমি থাকতে হবে। যাঁরা এমন ভাবনা পোষণ করেন, তাঁদের জানা উচিত, বাংলাদেশের মতো বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশের জন্য জমির পরিমাণের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জনপ্রতি ঘনফুট বা মিটার সপেস। একটি বাড়ির এখন মাপ হয় কত বর্গফুট, কত একর জমির ওপর নয়। ১ হাজার বা ২ হাজার স্কয়ার ফুটের বাড়িতে যেমন কুড়িজন মানুষের বাস করা সমীচীন নয়, একইভাবে পাঁচ হাজার ছাত্রের জন্য কত বর্গফুট জমি প্রয়োজন, তা পরিমাপ করা কঠিন নয়। বাংলাদেশের সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ শ থেকে হাজার একরের ওপর জমি আছে। তার পরও কেন তারা তাদের সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারছে না?
-এখানে এসেই মান্নান স্যার ধরা খেয়েছেন। তিনি এত এত লেখার পিছনে যে উদ্দেশ্যে সময় ব্যয় করলেন, তা পরিস্কার হয়ে গেছে। তিনি ঘুরে ফিরে ঐ একই গীত গাইলেন, যা আমি আমার লেখার প্রথম দিকে গেয়েছি। তার লেখার উদ্দেশ্য এখানেই প্রকাশ পেয়েছে। তাহলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী অবকাঠামো বা জমি থাকতে হবে এটা একটা ভ্রান্ত ধারনা। এটা বলে তিনি নিজেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষেই সাফাই গাওয়ার বিষয়টি পরিস্কার করে দিলেন। ঢাকা শহরে ১০-২০ কাঠা জায়গা কিনে ২০ তলা একটা ভবন করার মত টাকা নেই, এমন বিশ্ববিদ্যালয় এ ৫৪/৫৬টির মধ্যে একটাও নেই। প্রত্যেকটা বিশ্ববিদ্যালয় শত শত থেকে হাজার কোটি টাকারও বেশি আত্মসাত করে দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে বিভিন্ন নামে রেখেছেন এবং বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে তা পাচার করেছেন-এটা আমি আমার এ লেখার পরবর্তী অংশে তা প্রমান করে দেয়ার আশা রাখি। ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ, যুগোপযোগী কারিকুলাম তৈরি এবং তা নিয়মিত সংস্কার করা, শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত ও আধুনিক শিক্ষা উপকরণ জোগান দেওয়া, পর্যাপ্ত বই সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োজনানুযায়ী উপকরন সমৃদ্ধ ল্যাব, খেলার মাঠ, বিনোদনের ব্যবস্থা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকা অত্যাবশ্যকীয়। আর এগুলো কেবলই সম্ভব একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব স্থাপনায়। ভাড়া বাড়িতে এগুলোর চিন্তা করা একেবারেই অর্থহীন।
(৪) বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এশিয়ার পাঁচশ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় কখনো স্থান পায় না।
-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন ছাত্র মান্নান স্যারের এ লেখার উপর অনলাইনে মন্তব্য করেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এশিয়ার ৫৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে-এটা নাকি ঐ ছাত্রের জন্য গর্বের বিষয়। যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক সময় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসাবে খ্যাত ছিল, এখন তা এশিয়ার ৫৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে গন্য থাকাটা নাকি তার কাছে গর্বের বিষয়। তিনি আরো বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা না করে কেউ পাশ করতে পারেনা। এটাতো ঠিক নয় যে, কেউ পড়াশোনা না করে পাশ করবে। তবে এটাই বাস্তবতা যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার ভর্তি হলে সে পাশ করবেই। কারন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন খারাপ ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ভর্তি করেনা। ভাল বা মেধাবীদেরকেই ভর্তি করে থাকে। কাজেই ঐ মেধাবী ছাত্র তার মেধার কারনেই বেশিরভাগ সফলতা পায়। এখানে শিক্ষকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আসল ঘটনাটি এই যে, প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাতির কারন হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে বিদেশী ছাত্র-ছাত্রীদের যে আনাগোনা/পদচারনা ছিল, এখন আর সেটি নেই। তাই এ বিশ্ববিদ্যালয় এখন প্রাচ্য বাদ দিয়ে প্রতীচ্যের ৫৫০ এর মধ্যে তাকে জায়গা করে নিতে হয়। দু:খটা এখানেই। আর একটা কথা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি, লেখাপড়ার মান, শিক্ষকদের প্রশ্নপত্র তৈরি, গ্রেডিং ইত্যাকার বিষয়ে বহু কেলেংকারীর কথা সর্বজনবিদিত। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে মাতামাতি করার মত কোন কারন খুব একটা দেখছিনা।
আজকাল দেখা যায়, প্রাইমারী থেকে শুরু করে জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি, গ্রাজুয়েশন, পোস্ট গ্রাজুয়েশনে কোন কোন প্রতিষ্ঠান কতটা সাফল্য অর্জন করতে পেরেছে, কোন কোন প্রতিষ্ঠান শতভাগ পাশ করেছে-ফলাফল প্রকাশের পর থেকে এসব প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে মাসখানেক নিয়মিত নাতিদীর্ঘ কলাম, নিবন্ধ, প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়ে থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব প্রতিষ্ঠানের এত ভাল ফলাফল অর্জনের গুরু রহস্য কি? আসলে কিছুইনা। এসব প্রতিষ্ঠানে ইন্টারভিউ নিয়ে যাচাই-বাছাই করে সেরা ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ভর্তি করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা বাসায় পিতা-মাতার কাছে, প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের কাছে, কোচিং সেন্টারে ও প্রাইভেট পড়ে তারা তাদের সফলতা প্রমাণ করে। এতে ঐ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কৃতিত্ব ২৫-৩৫% এর বেশি নয় কোনক্রমেই। ঐসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদেরকে গ্রামের অজপাড়াগায়ের একটি প্রতিষ্ঠানে এক বছরের জন্য পাঠিয়ে দিয়ে দেখা যেতে পারে তারা অজপাড়াগায়ের একটি প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে কতটা ভাল ফলাফল অর্জনে সহায়তা করতে পারে। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, ঐ ২৫-৩০% এর বেশি তারা সাফল্য অর্জন করতে পারবেনা। ভাল প্রতিষ্ঠানে ভর্তিকৃত একজন ছাত্রের মেধা থাকে ৫০%। আর ২৫% শিক্ষকদের কর্তৃক প্রতিষ্ঠানে বিকশিত হয়, বাকীটা অভিভাবকদের কেয়ারনেস এবং প্রাইভেট টিউটর/কোচিং ইত্যাদির মাধ্যমে অর্জিত হয়। অজপাড়াগায়ের একটি প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত একজন ছাত্রের মেধা থাকে ২৫-৩৫%। অভিভাবকদের বেশিরভাগই অশিক্ষিত হওয়ায় অভিভাবকের কেয়ারনেস এবং টাকা পয়সার অভাবে কোচিং/প্রাইভেট এর মাধ্যমে জ্ঞানার্জন প্রায় শুন্যের কোঠায়। আর ২০-২৫% জ্ঞানার্জন করে প্রতিষ্ঠানে। আমার এ হিসাবে ১৯-২০ হতে পারে, তবে অজপাড়াগায়ের একটি প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত একজন ছাত্রের মধ্যে বেশিরভাগের পক্ষেই ভাল ফলাফল অর্জন করা সম্ভব হয়না এ কারনেই । আর যারা ভাল রেজাল্ট করে, তাদের উপর আল্লাহর একটা বিশেষ রহমত থাকে-এবং এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। এ কারনেই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পূর্বে অথবা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ভাল রেজাল্ট করতে বিফল হয়ে প্রতি বছর ঝরে পড়ে প্রায় ২ লাখ শিক্ষার্থী। আর যারা ঝরে পড়ছে তাদের ৯৯ ভাগই গ্রামাঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। শহুরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (ভাল) শিক্ষার্থী ভর্তির প্রতিযোগিতার কাছে হেরে গিয়ে তাদেরকে এ পরিস্থিতি বরণ করতে হয়। গ্রামাঞ্চলের এসব শিক্ষার্থীদের ধারনা, ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে না পারলে লেখাপড়া করে কী হবে? এ ধারনার বশবর্তী হয়েও এইচএসসি পাশের পর অনেকেই পড়ালেখার প্রতি বিমুখ হয়ে পড়ে। এছাড়া অর্থনৈতিক দূর্বলতার কারনে এসএসসি পাসের পর মেয়েদের মধ্যে অনেকেরই বিয়ে হয়ে যাওয়াও আরেকটা কারণ বলে মনে করা হয়ে থাকে।
দুই লাখ শিক্ষার্থীর ওপরে ফেল করার বা ঝরে পড়ার বিষয়টি একটা জাতির জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক, পীড়াদায়ক ও দুঃখজনকও বটে। ঝরে পড়া বা পরীক্ষায় ফেল করার প্রেক্ষিতে আত্মহননের ঘটনাও ঘটে চলছে প্রতিবছরই। তাই পাসের হার বাড়লেই চলবে না ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের দিকটাও দেখতে হবে। কেন তারা পারছে না? কোথায় তাদের সমস্যা? কেন একজন শিক্ষার্থী ফেল করে? কেন একজন শিক্ষার্থী রেজিস্ট্রেশন করেও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে? তার সঠিক কারন খুঁজে বের করে সমাধান করতে হবে। একথা মনে রাখা দরকার যে, পাসের হার বৃদ্ধি আর শিক্ষার মান এক জিনিস নয়। সবাইকে পাস করতে হবে। এ ধরনের মানসিকতা আমাদেরকে তৈরি করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা আর ফেল করা, ঝরে পড়া, আত্মহনন চাইনা। এ লক্ষ্য নিয়েই আমাদের সামনে অগ্রসর হওয়া উচিৎ। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র। তাদের ভিটে-বাড়ি বিক্রি করে ছেলে-মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করায় চাকরির আশায়। উন্নত দেশের ছেলে-মেয়েরা উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পরপরই চাকরি করার সুযোগ পায়। আমাদের দেশে সে সুযোগ নেই। এজন্য আমাদের দেশে শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষত, যোগ্য ও অর্ধযোগ্য বেকারের সংখ্যা বেশি।
গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এ ফলাফল বিপর্যয়ের অন্যতম কারন হলো, কোন ভাল ছাত্র উচ্চশিক্ষার পাট শেষ করার পর শিক্ষকতার পেশায় আসতে চায়না, আবার শিক্ষকতার পেশায় যুক্ত হলেও বেশিরভাগই গ্রামের কোন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হতে চায়না। সবাই শহরমূখী হয়ে পড়ে। যারা গ্রামাঞ্চলের প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকতা করে, তাদের অনেকেরই শিক্ষকতা করার কোন যোগ্যতাই নেই। এসব অর্ধযোগ্য শিক্ষকের কারনে গ্রামের ছাত্রদের মেধা বিকশিত হবার সুযোগ খুব একটা থাকেনা।
আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রাইমারি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত আসতে আসতে ঝরে যায় প্রায় দুই তৃতীয়াংশ ছাত্র-ছাত্রী। ফলাফল বিশ্লেষণে একটা বিষয় পরিস্কার যে, প্রতিবছরই পাসের হার এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তির হার বৃদ্ধির সাথে সাথে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে, যা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। ২০০৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত এ পাঁচ বছরে উচ্চ মাধ্যমিকে ঝরে পড়াদের হার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়:
২০০৭ সালে পরীক্ষায় অংশ নেয় ৫ লাখ ৩৩ হাজার ১৫৮ জন। এর মধ্যে পাস করে ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৭৪৯ জন। অকৃতকার্য হয়ে ঝরে পড়ে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৪০৯ জন। ২০০৮ সালে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ৬ লাখ ১২ হাজার ৩৮১ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে পাস করে ৪ লাখ ৬৬ হাজার ৫৭০ জন। অকৃতকার্য হয়ে ঝরে পড়ে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৮১১ জন। ২০০৯ সালে ৬ লাখ হাজার ৮৭২ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। এর মধ্যে পাস করে ৪ লাখ ৪২ হাজার ৩৮৯ জন। ওই বছর ঝরে পড়ে ১ লাখ ৬৫ হাজার ৪৭৩ জন। ২০১০ সালে ৭ লাখ ১৮ হাজার ৮৪ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিলেও পাস করে ৫ লাখ ৩৩ হাজার ৩৬৯ জন। ঝরে পড়ে ১ লাখ ৮৪ হাজার ৭১৫ জন। ২০১১ সালে এ বছর ৭ লাখ ৬৪ হাজার ৮২৮ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছেন ৫ লাখ ৭৪ হাজার ২৬১ জন। ঝরে পড়েছে বা ফেল করেছে ১ লাখ ৯০ হাজার ৫৬৭ জন। অর্থ্যাৎ ২০০৭ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এ ৫ বছরে পাসের হার যেমন বেড়েছে, তেমনি ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বেড়েছে প্রতিবছরই। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে স্কুল কর্তৃপক্ষ যেমন উদাসীন তেমনি সরকারের কোন উদ্যোগও চোখে পড়ছে না। সরকার পাসের হার বৃদ্ধির ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিলেও ঝরে পড়াদের ব্যাপারে তেমন কোন উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা নেই। সরকার প্রতিবছরই লিখিত ও মৌখিক দু'ধরনের পরীক্ষায়ই পাসের হার বাড়াতে পরীক্ষকদের একাধিকবার নির্দেশ দিয়ে জিপিএ-৫ এর সংখ্যা এবং পাসের হার বৃদ্ধির চেষ্টা করে সফলতা অর্জন করেছে ঠিকই, কিন্তু শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ ঘটাতে পারছেনা। সৃষ্টিশীল শিক্ষার্থী তৈরি করতে পারছেনা। সরকারের এ উদারনীতির ফলে তাদের রাজনৈতিক ফায়দা কিছুটা হাসিল হলেও জাতি একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের দিকে ক্রমাগতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে এইচএসসি পাশের পরে তাদেরকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন সংকটের প্রেক্ষিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ঝুকে পড়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের দিকে আরও একধাপ এগিয়ে যাচ্ছে। তাহলে আমাদের এ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ কী?
ড. বেগম জাহান আরা, সাবেক প্রফেসর, ইনস্টিটিউট অব মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজেস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: গত ১৭.০১.২০১১ ইং তারিখে দৈনিক সমকাল পত্রিকায় 'আরও নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়!' (তিনি ! চিহ্ন দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন, আর কোন নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন নেই, যারা আছে তারাই লুটে পুটে খাক) শিরোনামে লিখেছেন-
(১) দেশ স্বাধীন হলো ১৯৭১ সালে। তখন দেশে ছিল ৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৭.৫ কোটি। স্বাধীনতার ২০ বছর পর উচ্চশিক্ষার জন্য যে তরুণ প্রজন্ম তৈরি হলো, তাদের জন্য শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা অনিবার্য হয়ে পড়ল। সেই সুযোগই এনে দিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় ২০ বছর সময়ের মধ্যে এখন দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৫১টি (সরকার বলছে ৫৪/৫৬টি) বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।
-ড. বেগম জাহানারা হয়তো জানেননা যে, তরুণ প্রজন্মের জন্য শিক্ষার সুযোগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এনে দেয়নি। সরকার দিয়েছে। সরকার তাদেরকে শিক্ষাদানের/শিক্ষা সেবার সূযোগ দিয়েছে। কিন্তু কুলাঙ্গাররা সেটাকে পন্য ও ব্যবসায়ে পরিণত করেছে। সনদ বানিজ্য করছে। লেখাপড়া যা হচ্ছে, তা অশ্বডিম্ব।
(২) ইউজিসির নিয়ম অমান্য করায় সমপ্রতি ২২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য 'রেড এলার্ট' ঘোষণা করা হয়েছে। নিয়ম অমান্য করার প্রধান কারণ এক একর জমির ওপর নিজস্ব স্থায়ী ক্যামপাস তৈরি না করা। আগে ছিল ৫ একর জমির শর্ত। ঢাকা নগরে এক সঙ্গে ৫ একর জমি তো দূরের কথা, একটি প্লটে এক একর অর্থাৎ তিন বিঘা জায়গা পাওয়াও অসম্ভব।
-ড. জাহানারার এ বিষয়ে কোন কিছু বলার অর্থই হচ্ছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষাবলম্বন করা। ১৯৯২ সনে যখন আইনটি হয়, তখনই এ ধারাটি ছিল, কাজেই এ ১৮ বছরে তারা যে পরিমান টাকা আয় করেছে, তা দ্বারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত একটা বিশাল আয়তনের এক একটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সম্ভব। অপেক্ষা করুন, আমি প্রমাণ দিচ্ছি। ঢাকায় জায়গা না পেলে ঢাকার আশেপাশেতো জমির কোনই অভাব নেই। তারা বিম্ববিদ্যালয়ের টাকায় নিজেদের নামেতো কম স্থাবর-অস্থাবর সমপদ বা জমি কেনেননি? ঢাকার উপর থেকে জনসংখ্যার চাপ কমানোর জন্য হলেও ঢাকার বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস করলে সেখানে ছাত্র-ছাত্রী যাবেনা, এ ধুয়োতো তোলা যাবেনা। পড়াশোনার জন্য ছাত্ররা জাহান্নাম বলেন আর স্বর্গ বলেন সবখানেই যাবে। উদাহরণ দেয়ার কোন প্রয়োজন আছে কি? প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন।
(৩) জনবহুল এ দেশে একটি বাড়ি ভেঙে ২০-২২ টি ফ্ল্যাট হচ্ছে। সেখানেও মানুষ বসবাস করছে। জমি তো সেই ১০ কাঠা বা এক বিঘা। তো ফ্লোর স্পেস হিসাব করলে এক বিঘার ওপর ২০ বা ৪০টি ফ্ল্যাটের ফ্লোর স্পেস দাঁড়ায় ২০ বা ৪০ বিঘা। এটি তো সাধারণ অঙ্ক। ঘিঞ্জি বসতির এ দেশে এভাবে জমির হিসাব না করলে চলবে কেন?
-ম্যাডাম যা হিসাব দেখালেন, সেরকমওতো কেউ করে দেখালোনা এ পর্যন্ত। এখনোতো সবাই হোটেলের উপর, গার্মেন্টসের উপর, মার্কেটের উপর, মুদি দোকানের মত করে ব্যবসা করে যাচ্ছে। আপনার মত একজন শিক্ষিত মহিলার কাছ থেকে এ ধরনের লেখা আমরা কেউই আশা করি না। এসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যা চলছে, তা তুঘলকি কান্ড ছাড়া আর কিছুই নয়। বছরে লাখ টাকার উপরে টিউশন ফি আদায় করছে এক একজন ছাত্রের কাছ থেকে, আর এক একজন শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বেতন দিচ্ছে তাতে তাদের পেটও চলেনা। আর শিক্ষা দেবার মত যাদের যোগ্যতা আছে, তারাও সঠিকভাবে সে শিক্ষাটা দান করছেনা। শিক্ষকরা সেটুকুই দিচ্ছে, যেটুকু ঐ বেতনের বিনিময়ে দেয়া দরকার। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আর শিক্ষকদের মাঝখানে পড়ে অসহায়, বঞ্চিত ও প্রতারিত হচ্ছে ছাত্ররা। এক একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মাথাপিছু ব্যয় দেখলে সহজেই অনুমান করা যায়, নেয়া এবং দেয়ার মধ্যে আসমান-জমিন পার্থক্য।
(৪) সবকিছু গড়তে সময় লাগে। সংশোধনেও সময় লাগে।
-এ ব্যাপারে বলা যায়, যার এক-এ হয়না, তার একশোতেও হয়না। চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী। কথাটা আপনার জানা ও বোঝা দরকার। এসব হারামখোরেরা যেহেতু এ ১৭-১৮ বছরেও সংশোধন হয়নি, আর তাদের হবারও দরকার নেই। এখন তাদেরকে বন্ধ করে দিয়ে সমসংখ্যক নতুন বিশ্ববিদ্যালয় চালু করলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আর এসব ব্যবসায়ীদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেশছাড়া করা অত্যন্ত জরুরী। এদেশে শিক্ষানুরাগী, শিক্ষাউদ্যোক্তার প্রয়োজন রয়েছে, শিক্ষা ব্যবসায়ী ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের কোন প্রয়োজন নেই। যেখানে পারে সেখানে গিয়ে এ ব্যবসা করুক। কেউ বাধা দিবেনা। কিন্তু এদেশে এটা চলতে দেয়া বিবেকবানদের উচিৎ নয়। আপনার লেখা এর আগেও পড়েছি। কিন্তু বক্তব্য একই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে সাফাই গাওয়া (দালালী করা) ।
আজকাল দেখা যায়, প্রাইমারী থেকে শুরু করে জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি, গ্রাজুয়েশন, পোস্ট গ্রাজুয়েশনে কোন কোন প্রতিষ্ঠান কতটা সাফল্য অর্জন করতে পেয়েছে, কোন কোন প্রতিষ্ঠান শতভাগ পাশ করেছে-ফলাফল প্রকাশের পর থেকে এসব প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে মাসখানেক নিয়মিত নাতিদীর্ঘ কলাম, নিবন্ধ, প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়ে থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব প্রতিষ্ঠানের এত ভাল ফলাফল অর্জনের গুরু রহস্য কি? আসলে কিছুইনা। এসব প্রতিষ্ঠানে ইন্টারভিউ নিয়ে যাচাই-বাছাই করে সেরা ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ভর্তি করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা বাসায় পিতা-মাতার কাছে, প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের কাছে, কোচিং সেন্টাওে ও প্রাইভেট পড়ে তারা তাদের সফলতা প্রমাণ করে। এতে ঐ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কৃতিত্ব ২৫-৩৫% এর বেশি নয় কোনক্রমেই। ঐসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদেরকে গ্রামের অজপাড়াগায়ের একটি প্রতিষ্ঠানে এক বছরের জন্য পাঠিয়ে দিয়ে দেখা যেতে পারে তারা অজপাড়াগায়ের একটি প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে কতটা ভাল ফলাফল অর্জনে সহায়তা করতে পারে। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, ঐ ২৫-৩০% এর বেশি তারা সাফল্য অর্জন করতে পারবেনা। ভাল প্রতিষ্ঠানে ভর্তিকৃত একজন ছাত্রের মেধা থাকে ৫০%। আর ২৫% শিক্ষকদের কর্তৃক প্রতিষ্ঠানে বিকশিত হয়, বাকীটা অভিভাবকদের কেয়ারনেস এবং প্রাইভেট টিউটর/কোচিং ইত্যাদির মাধ্যমে অর্জিত হয়। অজপাড়াগায়ের একটি প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত একজন ছাত্রের মেধা থাকে ২৫-৩৫%। অভিভাবকদের বেশিরভাগই অশিক্ষিত হওয়ায় অভিভাবকের কেয়ারনেস এবং টাকা পয়সার অভাবে কোচিং/প্রাইভেট এর মাধ্যমে জ্ঞানার্জন প্রায় শুন্যের কোঠায়। আর ২০-২৫% জ্ঞানার্জন করে প্রতিষ্ঠানে। আমার এ হিসাবে ১৯-২০ হতে পারে, তবে অজপাড়াগায়ের একটি প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত একজন ছাত্রের মধ্যে বেশিরভাগের পক্ষেই ভাল ফলাফল অর্জন করা সম্ভব হয়না এ কারনেই । আর যারা ভাল রেজাল্ট করে, তাদের উপর আল্লাহর একটা বিশেষ রহমত থাকে-এবং এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। এ কারনেই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পূর্বে অথবা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ভাল রেজাল্ট করতে বিফল হয়ে প্রতি বছর ঝরে পড়ে প্রায় ২ লাখ শিক্ষার্থী। আর যারা ঝরে পড়ছে তাদের ৯৯ ভাগই গ্রামাঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। শহুরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (ভাল) শিক্ষার্থী ভর্তির প্রতিযোগিতার কাছে হেরে গিয়ে তাদেরকে এ পরিস্থিতি বরণ করতে হয়। গ্রামাঞ্চলের এসব শিক্ষার্থীদের ধারনা, ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে না পারলে লেখাপড়া করে কী হবে? এ ধারনার বশবর্তী হয়েও এইচএসসি পাশের পর অনেকেই পড়ালেখার প্রতি বিমুখ হয়ে পড়ে। এছাড়া অর্থনৈতিক দূর্বলতার কারনে এসএসসি পাসের পর মেয়েদের মধ্যে অনেকেরই বিয়ে হয়ে যাওয়াও আরেকটা কারণ বলে মনে করা হয়ে থাকে।
দুই লাখ শিক্ষার্থীর ওপরে ফেল করার বা ঝরে পড়ার বিষয়টি একটা জাতির জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক, পীড়াদায়ক ও দুঃখজনকও বটে। ঝরে পড়া বা পরীক্ষায় ফেল করার প্রেক্ষিতে আত্মহননের ঘটনাও ঘটে চলছে প্রতিবছরই। তাই পাসের হার বাড়লেই চলবে না ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের দিকটাও দেখতে হবে। কেন তারা পারছে না? কোথায় তাদের সমস্যা? কেন একজন শিক্ষার্থী ফেল করে? কেন একজন শিক্ষার্থী রেজিস্ট্রেশন করেও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে? তার সঠিক কারন খুঁজে বের করে সমাধান করতে হবে। একথা মনে রাখা দরকার যে, পাসের হার বৃদ্ধি আর শিক্ষার মান এক জিনিস নয়। সবাইকে পাস করতে হবে। এ ধরনের মানসিকতা আমাদেরকে তৈরি করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা আর ফেল করা, ঝরে পড়া, আত্মহনন চাইনা। এ লক্ষ্য নিয়েই আমাদের সামনে অগ্রসর হওয়া উচিৎ। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র। তাদের ভিটে-বাড়ি বিক্রি করে ছেলে-মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করায় চাকরির আশায়। উন্নত দেশের ছেলে-মেয়েরা উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পরপরই চাকরি করার সুযোগ পায়। আমাদের দেশে সে সুযোগ নেই। এজন্য আমাদের দেশে শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষত, যোগ্য ও অর্ধযোগ্য বেকারের সংখ্যা বেশি।
গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এ ফলাফল বিপর্যয়ের অন্যতম কারন হলো, কোন ভাল ছাত্র উচ্চশিক্ষার পাট শেষ করার পর শিক্ষকতার পেশায় আসতে চায়না, আবার শিক্ষকতার পেশায় যুক্ত হলেও বেশিরভাগই গ্রামের কোন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হতে চায়না। সবাই শহরমূখী হয়ে পড়ে। যারা গ্রামাঞ্চলের প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকতা করে, তাদের অনেকেরই শিক্ষকতা করার কোন যোগ্যতাই নেই। এসব অর্ধযোগ্য শিক্ষকের কারনে গ্রামের ছাত্রদের মেধা বিকশিত হবার সুযোগ খুব একটা থাকেনা।
আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রাইমারি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত আসতে আসতে ঝরে যায় প্রায় দুই তৃতীয়াংশ ছাত্র-ছাত্রী। ফলাফল বিশ্লেষণে একটা বিষয় পরিস্কার যে, প্রতিবছরই পাসের হার এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তির হার বৃদ্ধির সাথে সাথে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে, যা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। ২০০৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত এ পাঁচ বছরে উচ্চ মাধ্যমিকে ঝরে পড়াদের হার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়:
২০০৭ সালে পরীক্ষায় অংশ নেয় ৫ লাখ ৩৩ হাজার ১৫৮ জন। এর মধ্যে পাস করে ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৭৪৯ জন। অকৃতকার্য হয়ে ঝরে পড়ে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৪০৯ জন। ২০০৮ সালে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ৬ লাখ ১২ হাজার ৩৮১ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে পাস করে ৪ লাখ ৬৬ হাজার ৫৭০ জন। অকৃতকার্য হয়ে ঝরে পড়ে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৮১১ জন। ২০০৯ সালে ৬ লাখ হাজার ৮৭২ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। এর মধ্যে পাস করে ৪ লাখ ৪২ হাজার ৩৮৯ জন। ওই বছর ঝরে পড়ে ১ লাখ ৬৫ হাজার ৪৭৩ জন। ২০১০ সালে ৭ লাখ ১৮ হাজার ৮৪ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিলেও পাস করে ৫ লাখ ৩৩ হাজার ৩৬৯ জন। ঝরে পড়ে ১ লাখ ৮৪ হাজার ৭১৫ জন। ২০১১ সালে এ বছর ৭ লাখ ৬৪ হাজার ৮২৮ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছেন ৫ লাখ ৭৪ হাজার ২৬১ জন। ঝরে পড়েছে বা ফেল করেছে ১ লাখ ৯০ হাজার ৫৬৭ জন। অর্থ্যাৎ ২০০৭ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এ ৫ বছরে পাসের হার যেমন বেড়েছে, তেমনি ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বেড়েছে প্রতিবছরই। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে স্কুল কর্তৃপক্ষ যেমন উদাসীন তেমনি সরকারের কোন উদ্যোগও চোখে পড়ছে না। সরকার পাসের হার বৃদ্ধির ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিলেও ঝরে পড়াদের ব্যাপারে তেমন কোন উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা নেই। সরকার প্রতিবছরই লিখিত ও মৌখিক দু'ধরনের পরীক্ষায়ই পাসের হার বাড়াতে পরীক্ষকদের একাধিকবার নির্দেশ দিয়ে জিপিএ-৫ এর সংখ্যা এবং পাসের হার বৃদ্ধির চেষ্টা করে সফলতা অর্জন করেছে ঠিকই, কিন্তু শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ ঘটাতে পারছেনা। সৃষ্টিশীল শিক্ষার্থী তৈরি করতে পারছেনা। সরকারের এ উদারনীতির ফলে তাদের রাজনৈতিক ফায়দা কিছুটা হাসিল হলেও জাতি একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের দিকে ক্রমাগতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে এইচএসসি পাশের পরে তাদেরকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন সংকটের প্রেক্ষিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ঝুকে পড়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের দিকে আরও একধাপ এগিয়ে যাচ্ছে। তাহলে আমাদের এ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ কী?
ড. বেগম জাহান আরা, সাবেক প্রফেসর, ইনস্টিটিউট অব মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজেস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: গত ১৭.০১.২০১১ ইং তারিখে দৈনিক সমকাল পত্রিকায় 'আরও নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়!' (তিনি ! চিহ্ন দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন, আর কোন নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন নেই, যারা আছে তারাই লুটে পুটে খাক) শিরোনামে লিখেছেন-
(১) দেশ স্বাধীন হলো ১৯৭১ সালে। তখন দেশে ছিল ৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৭.৫ কোটি। স্বাধীনতার ২০ বছর পর উচ্চশিক্ষার জন্য যে তরুণ প্রজন্ম তৈরি হলো, তাদের জন্য শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা অনিবার্য হয়ে পড়ল। সেই সুযোগই এনে দিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় ২০ বছর সময়ের মধ্যে এখন দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৫১টি (সরকার বলছে ৫৪/৫৬টি) বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।
-ড. বেগম জাহানারা হয়তো জানেননা যে, তরুণ প্রজন্মের জন্য শিক্ষার সুযোগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এনে দেয়নি। সরকার দিয়েছে। সরকার তাদেরকে শিক্ষাদানের/শিক্ষা সেবার সূযোগ দিয়েছে। কিন্তু কুলাঙ্গাররা সেটাকে পন্য ও ব্যবসায়ে পরিণত করেছে। সনদ বানিজ্য করছে। লেখাপড়া যা হচ্ছে, তা অশ্বডিম্ব।
(২) ইউজিসির নিয়ম অমান্য করায় সমপ্রতি ২২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য 'রেড এলার্ট' ঘোষণা করা হয়েছে। নিয়ম অমান্য করার প্রধান কারণ এক একর জমির ওপর নিজস্ব স্থায়ী ক্যামপাস তৈরি না করা। আগে ছিল ৫ একর জমির শর্ত। ঢাকা নগরে এক সঙ্গে ৫ একর জমি তো দূরের কথা, একটি প্লটে এক একর অর্থাৎ তিন বিঘা জায়গা পাওয়াও অসম্ভব।
-ড. জাহানারার এ বিষয়ে কোন কিছু বলার অর্থই হচ্ছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষাবলম্বন করা। ১৯৯২ সনে যখন আইনটি হয়, তখনই এ ধারাটি ছিল, কাজেই এ ১৮ বছরে তারা যে পরিমান টাকা আয় করেছে, তা দ্বারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত একটা বিশাল আয়তনের এক একটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সম্ভব। অপেক্ষা করুন, আমি প্রমাণ দিচ্ছি। ঢাকায় জায়গা না পেলে ঢাকার আশেপাশেতো জমির কোনই অভাব নেই। তারা বিম্ববিদ্যালয়ের টাকায় নিজেদের নামেতো কম স্থাবর-অস্থাবর সমপদ বা জমি কেনেননি? ঢাকার উপর থেকে জনসংখ্যার চাপ কমানোর জন্য হলেও ঢাকার বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যামপাস করলে সেখানে ছাত্র-ছাত্রী যাবেনা, এ ধুয়োতো তোলা যাবেনা। পড়াশোনার জন্য ছাত্ররা জাহান্নাম বলেন আর স্বর্গ বলেন সবখানেই যাবে। উদাহরণ দেয়ার কোন প্রয়োজন আছে কি? প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন।
(৩) জনবহুল এ দেশে একটি বাড়ি ভেঙে ২০-২২ টি ফ্ল্যাট হচ্ছে। সেখানেও মানুষ বসবাস করছে। জমি তো সেই ১০ কাঠা বা এক বিঘা। তো ফ্লোর সপেস হিসাব করলে এক বিঘার ওপর ২০ বা ৪০টি ফ্ল্যাটের ফ্লোর সপেস দাঁড়ায় ২০ বা ৪০ বিঘা। এটি তো সাধারণ অঙ্ক। ঘিঞ্জি বসতির এ দেশে এভাবে জমির হিসাব না করলে চলবে কেন?
-ম্যাডাম যা হিসাব দেখালেন, সেরকমওতো কেউ করে দেখালোনা এ পর্যন্ত। এখনোতো সবাই হোটেলের উপর, গার্মেন্টসের উপর, মার্কেটের উপর, মুদি দোকানের মত করে ব্যবসা করে যাচ্ছে। আপনার মত একজন শিক্ষিত মহিলার কাছ থেকে এ ধরনের লেখা আমরা কেউই আশা করি না। এসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যা চলছে, তা তুঘলকি কান্ড ছাড়া আর কিছুই নয়। বছরে লাখ টাকার উপরে টিউশন ফি আদায় করছে এক একজন ছাত্রের কাছ থেকে, আর এক একজন শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বেতন দিচ্ছে তাতে তাদের পেটও চলেনা। আর শিক্ষা দেবার মত যাদের যোগ্যতা আছে, তারাও সঠিকভাবে সে শিক্ষাটা দান করছেনা। শিক্ষকরা সেটুকুই দিচ্ছে, যেটুকু ঐ বেতনের বিনিময়ে দেয়া দরকার। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আর শিক্ষকদের মাঝখানে পড়ে অসহায়, বঞ্চিত ও প্রতারিত হচ্ছে ছাত্ররা। এক একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মাথাপিছু ব্যয় দেখলে সহজেই অনুমান করা যায়, নেয়া এবং দেয়ার মধ্যে আসমান-জমিন পার্থক্য।
(৪) সবকিছু গড়তে সময় লাগে। সংশোধনেও সময় লাগে।
-এ ব্যাপারে বলা যায়, যার এক-এ হয়না, তার একশোতেও হয়না। চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী। কথাটা আপনার জানা ও বোঝা দরকার। এসব হারামখোরেরা যেহেতু এ ১৭-১৮ বছরেও সংশোধন হয়নি, আর তাদের হবারও দরকার নেই। এখন তাদেরকে বন্ধ করে দিয়ে সমসংখ্যক নতুন বিশ্ববিদ্যালয় চালু করলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আর এসব ব্যবসায়ীদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেশছাড়া করা অত্যন্ত জরুরী। এদেশে শিক্ষানুরাগী, শিক্ষাউদ্যোক্তার প্রয়োজন রয়েছে, শিক্ষা ব্যবসায়ী ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের কোন প্রয়োজন নেই। যেখানে পারে সেখানে গিয়ে এ ব্যবসা করুক। কেউ বাধা দিবেনা। কিন্তু এদেশে এটা চলতে দেয়া বিবেকবানদের উচিৎ নয়। আপনার লেখা এর আগেও পড়েছি। কিন্তু বক্তব্য একই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে সাফাই গাওয়া (দালালী করা)।
দেশে যদি একটাও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় না থাকে, তথাপি কোন সমস্যা হবেনা, যেমন আগে হয়নি। আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারলে যেমন তারা সরকারি বা বেসরকারি কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে পড়াশোনা করতো, এখনো তাই করবে। অন্তত: এতটুকু শান্তনা তাদের থাকবে যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে সনদ কেনার মত অপবাদ তাদের মাথা পেতে নিতে হবেনা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সব ছাত্র-ছাত্রীরাই খারাপ মানের তা কিন্তু নয়। অনেক মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরাও আজকাল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পেরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। অথচ তাদেরকেও ঢালাওভাবে সনদ কেনার মত অপবাদ মাথায় নিতে হচ্ছে। সনদ যে বিক্রি হয়না, তাতো নয়। ৫৪/৫৬ টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বছরে লক্ষাধিক সনদ যে বিক্রি হয়, এতে কোন সন্দেহ করার অবকাশ নেই। এমনও দেখা যাচ্ছে যে, কোন কোন ছাত্র-ছাত্রী এসএসসি ও এইচএসসিতে দ্বিতীয়/তৃতীয় বিভাগে পাশ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে অনার্স কিংবা মাস্টার্সে অনায়াসে প্রথম বিভাগ অথবা সিজিপিএ ৪.০০ এর মধ্যে ৪.০০ পাচ্ছে। এর ফল অবশ্য ভাল হচ্ছেনা। কারন চাকুরীর বাজারে প্রবেশ পথেই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে তাদেরকে যে, তাদের এরকম অপ্রত্যাশিত ফলাফলের মাজেজাটা কী?
বেসরকারি বিশবিদ্যালয়ের পক্ষে সাফাই গেয়ে যারা সনদ বানিজ্যকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করেছেন, তাদের কিছু লেখার উপর আলোকপাত করা হলো:
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আবদুল মান্নান: গত ২৭.০৫.২০১১ ইং তারিখে দৈনিক প্রথম আলো প্রত্রিকায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আবদুল মান্নান কর্তৃক 'ভাল বিশ্ববিদ্যালয় মন্দ বিশ্ববিদ্যালয়' শিরোনামে এক নিবন্ধে অনেক বিষয়েরই অবতারনা করেছেন। এখানে তার কিছু অংশ উল্লেখ করে কিছুটা যোগ, অনুযোগ, বিয়োগ করতে চাই।
(১) "বাংলাদেশে সামপ্রতিক কালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাধিক্যের কারণে অনেকেই শিক্ষক হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি নিয়ে ঢুকে পড়েছেন, যাঁদের ওই পর্যায়ে শিক্ষকতা করার তেমন কোনো যোগ্যতাই নেই। গত তিন দশকে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-উভয়ের সংখ্যা বেড়েছে ঠিক, তবে শিক্ষার মান কতটুকু বেড়েছে বা যা ছিল তা কতটুকু বজায় থেকেছে, এ নিয়ে এখন ভাবার সময় হয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স এখনো কম, সেহেতু এ মন্তব্য অনেকটা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এ মন্তব্যের আওতামুক্ত, তা কিন্তু নয়। কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও এমন অনেক শিক্ষক আছেন, যাঁদের এই পেশায় আসা উচিত হয়নি।
-তিনি যাদেরকে এ পেশায় আসা উচিৎ হয়নি বলেই তিনি কেন যেন একটু নিজেকে বাচিয়ে লেখার চেষ্টা করছেন, তাদের এ পেশায় আসার কোন যোগ্যতা প্রকৃতপক্ষেই নেই। কিন্ত তারা এসেছে। আমাদের জাতির জন্য এটা একটা লজ্জার বিষয় যে, আমাদের দেশে যারা ভাল বা মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী হিসাবে পরিচিত, তারা কেউ শিক্ষকতা পেশায় এখন আর আসতে চাচ্ছেন না। তারা ব্যাংক, বীমা, বহুজাতিক ও বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে এবং বিদেশে গিয়ে যে কোন পেশায় চাকুরী করছে দেধারছে। তার কারন একটাই শিক্ষকদের বেতনভাতা এতটাই কম যে, তা দ্বারা শিক্ষক হিসাবে তাদের মান-সম্মান বজায় রেখে জীবিকা নির্বাহ করা সম্ভব নয়, যদি তারা সৎভাবে জীবনযাপন করেন। যদিও সৎ শব্দটি আজকাল অভিধান থেকে বিতারিত প্রায়। এ শব্দটি বাচ্চাদের ব্যাকরণ বইতে বিপরিত শব্দ পড়ানোর মত একটা বিষয় ছাড়া এখন আর কিছুই নয়। আজকাল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন কোনটির বেতনভাতার পরিমান সন্তোষজনক, কিন্তু অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়েরই বেতনভাতার পরিমান এতটাই কম যে, এগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয় না বলে কোন কোচিং সেন্টার কিংবা কেজি স্কুল বলা যেতে পারে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জীবনযাত্রার মান এতটাই খারাপ যা বলার অপেক্ষা রাখেনা। দেশে বেকার সমসা এখন এতটাই প্রকট যে, যে যেখানে যেভাবে পারছে ঢুকে পরছে। পেট বাচাতে হবে। পরিবার বাচাতে হবে। কারন লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে অভিভাবকরা একটা নিরাপদ ভবিষ্যত রচনা করার জন্যইতো ছেলেমেয়েদেরকে পড়িয়েছেন। এখনই উদাহরন দিচ্ছিনা। পরবর্ততে উদাহরন দিয়ে দিব বলে আশা রাখি।
তিনি আরো লিখেছেন (২) "অনুজপ্রতিম সহকর্মী ও শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বছর কয়েক আগে অনেকটা আক্ষেপ করে প্রথম আলোয় লিখেছিলেন, অবস্থার উন্নতি না হলে দেশের অনেক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় একদিন হয়তো আদমজী পাটকলের মতো বন্ধ করে দিতে হবে। এর মধ্যে হয়তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও থাকবে। ........................ ড. জাফর ইকবাল আসলে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চরম হতাশাব্যঞ্জক অবস্থা দেখে এমন একটি মন্তব্য করেছিলেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান নিয়ে হরদম একশ্রেণীর গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ ও বিজ্ঞ আলোচক-বিশ্লেষকেরা বিভিন্ন ফোরাম মাতিয়ে রাখেন। কদাচিৎ তাঁরা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে মাথা ঘামান।
-কথাটার ভিতর কিছুটা সত্যতো আছেই। আমি এ লেখার গোড়ার দিকে এ কথা আগেও বলেছি যে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাইতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের খন্ডকালীন শিক্ষকদের একটা বড় অংশ। তাদের একেকজন শিক্ষক কমপক্ষে ৩-৪টি থেকে ৭-৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও ৩-৪টি করে কোর্সে পাঠদান করে থাকেন। এতে তার মূল দায়িত্ব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা ঠকছে। তারা না পারছে ঘর সামলাতে না পারছে পর সামলাতে। ফলে সরকারি-বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানই ব্যহত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে আদমজী পাটকলের মতো সরকারি-বেসরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই হয়তো একদিন বন্ধ করে দিতে হবে-শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়।
(২) যতই নিয়মিত বিরতি দিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ইটপাটকেল মারা হোক, একটি কথা সবাইকে মানতেই হবে, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ভালো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছে। এখানে প্রথমে যোগ্যতা অনুসারে প্রার্থীদের ছোট তালিকা করা হয়। এরপর তাঁদের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সিনিয়র শিক্ষকদের সামনে একটি ছোট সেমিনার দিতে হয়। তারপর মৌখিক পরীক্ষা হয় এবং তাঁকে যদি যোগ্য মনে করা হয়, তাহলে তাঁর প্রথম চুক্তি হয় এক বছরের জন্য। এই এক বছর (সাধারণত তিনটি সেমিস্টার) ছাত্র ও বিভাগীয় প্রধান বা কোনো কোনো সময় ডিন তাঁকে কেমন মূল্যায়ন করেন, তা দেখা হয় এবং সবকিছু যদি সন্তোষজনক হয় তাহলে তাঁর চুক্তি নবায়ন করা হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস মিস করা বা দেরিতে আসা অনেকটা অকল্পনীয়।
-এ বিষয়ে বলা যায় যে, তিনি যা বলেছেন তা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দু'চারটির বেলায় প্রযোজ্য হতে পারে, বাকীগুলোর অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে, তারা শিক্ষক নিয়োগের সময় প্রার্থীকে প্রথমেই প্রশ্ন করে বসেন, কত টাকা বেতন চান? ইন্টারভিউর প্রথম প্রশ্নটাই যদি হয় এরকম, তাহলে আর কি বলার আছে? যে প্রশ্নটি সবকিছুর শেষে আসার কথা, সেটাই যদি হয় প্রথম প্রশ্ন তাহলে মান্নান স্যার কি বলবেন এ ব্যাপারে? আমার ধারনা, তিনি হয়তো দু-একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ কমিটির এক্সটার্নাল ছিলেন, তাই তার এ ধারনা হতে পারে। কারন অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই এসব এক্সটার্নালদের সামনে এভাবেই অভিনয় করে থাকে। কোন কোন এক্সটার্নালদেরকে আবার খাম ধরিয়ে দিলেই হলো। তাদের উপস্থিতিরও প্রয়োজন হয়না। এটাই বাস্তবতা। আর চুক্তি নবায়ন এর বিষয়টি খুবই নগন্য। বেশিরভাগ শিক্ষককেই নবায়ন বা বছর শেষে বেতন বৃদ্ধির সময় এলেই তাদেরকে বিভিন্নভাবে আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেয়া হয় যে, তাদের আর প্রয়োজন নেই। তাই এসব শিক্ষকরা বাধ্য হয়ে চলে যাচ্ছেন, নয়তো মুচলেকা দিয়ে অবহেলিতভাবে রয়ে যাচ্ছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুন শিক্ষকদের এক একটা ট্রেনিং সেন্টার যেন। এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পাড়ি জমায়। আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আবার কম বেতনে নতুন মুখ নিয়োগ দেয়। এতে ক্ষতি হয় ছাত্র-ছাত্রীদের। তারা কোনকালেই অভিজ্ঞ শিক্ষকের কাছ থেকে বেশিদিন পাঠ গ্রহণ করতে পারেননা। তারা আবার নতুন শিক্ষক, নতুন করে পরিচয়, নতুন করে পড়ার স্টাইল ইত্যাদি রপ্ত করতে করতেই সেমিস্টার শেষ। এটাই হচ্ছে বাস্তব চিত্র।
(৩) কারও কারও একটি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় মানে তার অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের জমি থাকতে হবে। যাঁরা এমন ভাবনা পোষণ করেন, তাঁদের জানা উচিত, বাংলাদেশের মতো বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশের জন্য জমির পরিমাণের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জনপ্রতি ঘনফুট বা মিটার সপেস। একটি বাড়ির এখন মাপ হয় কত বর্গফুট, কত একর জমির ওপর নয়। ১ হাজার বা ২ হাজার স্কয়ার ফুটের বাড়িতে যেমন কুড়িজন মানুষের বাস করা সমীচীন নয়, একইভাবে পাঁচ হাজার ছাত্রের জন্য কত বর্গফুট জমি প্রয়োজন, তা পরিমাপ করা কঠিন নয়। বাংলাদেশের সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ শ থেকে হাজার একরের ওপর জমি আছে। তার পরও কেন তারা তাদের সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারছে না?
-এখানে এসেই মান্নান স্যার ধরা খেয়েছেন। তিনি এত এত লেখার পিছনে যে উদ্দেশ্যে সময় ব্যয় করলেন, তা পরিস্কার হয়ে গেছে। তিনি ঘুরে ফিরে ঐ একই গীত গাইলেন, যা আমি আমার লেখার প্রথম দিকে গেয়েছি। তার লেখার উদ্দেশ্য এখানেই প্রকাশ পেয়েছে। তাহলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী অবকাঠামো বা জমি থাকতে হবে এটা একটা ভ্রান্ত ধারনা। এটা বলে তিনি নিজেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষেই সাফাই গাওয়ার বিষয়টি পরিস্কার করে দিলেন। ঢাকা শহরে ১০-২০ কাঠা জায়গা কিনে ২০ তলা একটা ভবন করার মত টাকা নেই, এমন বিশ্ববিদ্যালয় এ ৫৪/৫৬টির মধ্যে একটাও নেই। প্রত্যেকটা বিশ্ববিদ্যালয় শত শত থেকে হাজার কোটি টাকারও বেশি আত্মসাত করে দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে বিভিন্ন নামে রেখেছেন এবং বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে তা পাচার করেছেন-এটা আমি আমার এ লেখার পরবর্তী অংশে তা প্রমান করে দেয়ার আশা রাখি। ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ, যুগোপযোগী কারিকুলাম তৈরি এবং তা নিয়মিত সংস্কার করা, শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত ও আধুনিক শিক্ষা উপকরণ জোগান দেওয়া, পর্যাপ্ত বই সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োজনানুযায়ী উপকরন সমৃদ্ধ ল্যাব, খেলার মাঠ, বিনোদনের ব্যবস্থা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকা অত্যাবশ্যকীয়। আর এগুলো কেবলই সম্ভব একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব স্থাপনায়। ভাড়া বাড়িতে এগুলোর চিন্তা করা একেবারেই অর্থহীন।
(৪) বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এশিয়ার পাঁচশ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় কখনো স্থান পায় না।
-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন ছাত্র মান্নান স্যারের এ লেখার উপর অনলাইনে মন্তব্য করেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এশিয়ার ৫৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে-এটা নাকি ঐ ছাত্রের জন্য গর্বের বিষয়। যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক সময় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসাবে খ্যাত ছিল, এখন তা এশিয়ার ৫৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে গন্য থাকাটা নাকি তার কাছে গর্বের বিষয়। তিনি আরো বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা না করে কেউ পাশ করতে পারেনা। এটাতো ঠিক নয় যে, কেউ পড়াশোনা না করে পাশ করবে। তবে এটাই বাস্তবতা যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার ভর্তি হলে সে পাশ করবেই। কারন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন খারাপ ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ভর্তি করেনা। ভাল বা মেধাবীদেরকেই ভর্তি করে থাকে। কাজেই ঐ মেধাবী ছাত্র তার মেধার কারনেই বেশিরভাগ সফলতা পায়। এখানে শিক্ষকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আসল ঘটনাটি এই যে, প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাতির কারন হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে বিদেশী ছাত্র-ছাত্রীদের যে আনাগোনা/পদচারনা ছিল, এখন আর সেটি নেই। তাই এ বিশ্ববিদ্যালয় এখন প্রাচ্য বাদ দিয়ে প্রতীচ্যের ৫৫০ এর মধ্যে তাকে জায়গা করে নিতে হয়। দু:খটা এখানেই। আর একটা কথা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি, লেখাপড়ার মান, শিক্ষকদের প্রশ্নপত্র তৈরি, গ্রেডিং ইত্যাকার বিষয়ে বহু কেলেংকারীর কথা সর্বজনবিদিত। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে মাতামাতি করার মত কোন কারন খুব একটা দেখছিনা।
আজকাল দেখা যায়, প্রাইমারী থেকে শুরু করে জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি, গ্রাজুয়েশন, পোস্ট গ্রাজুয়েশনে কোন কোন প্রতিষ্ঠান কতটা সাফল্য অর্জন করতে পেরেছে, কোন কোন প্রতিষ্ঠান শতভাগ পাশ করেছে-ফলাফল প্রকাশের পর থেকে এসব প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে মাসখানেক নিয়মিত নাতিদীর্ঘ কলাম, নিবন্ধ, প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়ে থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব প্রতিষ্ঠানের এত ভাল ফলাফল অর্জনের গুরু রহস্য কি? আসলে কিছুইনা। এসব প্রতিষ্ঠানে ইন্টারভিউ নিয়ে যাচাই-বাছাই করে সেরা ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ভর্তি করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা বাসায় পিতা-মাতার কাছে, প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের কাছে, কোচিং সেন্টারে ও প্রাইভেট পড়ে তারা তাদের সফলতা প্রমাণ করে। এতে ঐ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কৃতিত্ব ২৫-৩৫% এর বেশি নয় কোনক্রমেই। ঐসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদেরকে গ্রামের অজপাড়াগায়ের একটি প্রতিষ্ঠানে এক বছরের জন্য পাঠিয়ে দিয়ে দেখা যেতে পারে তারা অজপাড়াগায়ের একটি প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে কতটা ভাল ফলাফল অর্জনে সহায়তা করতে পারে। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, ঐ ২৫-৩০% এর বেশি তারা সাফল্য অর্জন করতে পারবেনা। ভাল প্রতিষ্ঠানে ভর্তিকৃত একজন ছাত্রের মেধা থাকে ৫০%। আর ২৫% শিক্ষকদের কর্তৃক প্রতিষ্ঠানে বিকশিত হয়, বাকীটা অভিভাবকদের কেয়ারনেস এবং প্রাইভেট টিউটর/কোচিং ইত্যাদির মাধ্যমে অর্জিত হয়। অজপাড়াগায়ের একটি প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত একজন ছাত্রের মেধা থাকে ২৫-৩৫%। অভিভাবকদের বেশিরভাগই অশিক্ষিত হওয়ায় অভিভাবকের কেয়ারনেস এবং টাকা পয়সার অভাবে কোচিং/প্রাইভেট এর মাধ্যমে জ্ঞানার্জন প্রায় শুন্যের কোঠায়। আর ২০-২৫% জ্ঞানার্জন করে প্রতিষ্ঠানে। আমার এ হিসাবে ১৯-২০ হতে পারে, তবে অজপাড়াগায়ের একটি প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত একজন ছাত্রের মধ্যে বেশিরভাগের পক্ষেই ভাল ফলাফল অর্জন করা সম্ভব হয়না এ কারনেই । আর যারা ভাল রেজাল্ট করে, তাদের উপর আল্লাহর একটা বিশেষ রহমত থাকে-এবং এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। এ কারনেই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পূর্বে অথবা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ভাল রেজাল্ট করতে বিফল হয়ে প্রতি বছর ঝরে পড়ে প্রায় ২ লাখ শিক্ষার্থী। আর যারা ঝরে পড়ছে তাদের ৯৯ ভাগই গ্রামাঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। শহুরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (ভাল) শিক্ষার্থী ভর্তির প্রতিযোগিতার কাছে হেরে গিয়ে তাদেরকে এ পরিস্থিতি বরণ করতে হয়। গ্রামাঞ্চলের এসব শিক্ষার্থীদের ধারনা, ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে না পারলে লেখাপড়া করে কী হবে? এ ধারনার বশবর্তী হয়েও এইচএসসি পাশের পর অনেকেই পড়ালেখার প্রতি বিমুখ হয়ে পড়ে। এছাড়া অর্থনৈতিক দূর্বলতার কারনে এসএসসি পাসের পর মেয়েদের মধ্যে অনেকেরই বিয়ে হয়ে যাওয়াও আরেকটা কারণ বলে মনে করা হয়ে থাকে।
দুই লাখ শিক্ষার্থীর ওপরে ফেল করার বা ঝরে পড়ার বিষয়টি একটা জাতির জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক, পীড়াদায়ক ও দুঃখজনকও বটে। ঝরে পড়া বা পরীক্ষায় ফেল করার প্রেক্ষিতে আত্মহননের ঘটনাও ঘটে চলছে প্রতিবছরই। তাই পাসের হার বাড়লেই চলবে না ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের দিকটাও দেখতে হবে। কেন তারা পারছে না? কোথায় তাদের সমস্যা? কেন একজন শিক্ষার্থী ফেল করে? কেন একজন শিক্ষার্থী রেজিস্ট্রেশন করেও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে? তার সঠিক কারন খুঁজে বের করে সমাধান করতে হবে। একথা মনে রাখা দরকার যে, পাসের হার বৃদ্ধি আর শিক্ষার মান এক জিনিস নয়। সবাইকে পাস করতে হবে। এ ধরনের মানসিকতা আমাদেরকে তৈরি করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা আর ফেল করা, ঝরে পড়া, আত্মহনন চাইনা। এ লক্ষ্য নিয়েই আমাদের সামনে অগ্রসর হওয়া উচিৎ। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র। তাদের ভিটে-বাড়ি বিক্রি করে ছেলে-মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করায় চাকরির আশায়। উন্নত দেশের ছেলে-মেয়েরা উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পরপরই চাকরি করার সুযোগ পায়। আমাদের দেশে সে সুযোগ নেই। এজন্য আমাদের দেশে শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষত, যোগ্য ও অর্ধযোগ্য বেকারের সংখ্যা বেশি।
গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এ ফলাফল বিপর্যয়ের অন্যতম কারন হলো, কোন ভাল ছাত্র উচ্চশিক্ষার পাট শেষ করার পর শিক্ষকতার পেশায় আসতে চায়না, আবার শিক্ষকতার পেশায় যুক্ত হলেও বেশিরভাগই গ্রামের কোন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হতে চায়না। সবাই শহরমূখী হয়ে পড়ে। যারা গ্রামাঞ্চলের প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকতা করে, তাদের অনেকেরই শিক্ষকতা করার কোন যোগ্যতাই নেই। এসব অর্ধযোগ্য শিক্ষকের কারনে গ্রামের ছাত্রদের মেধা বিকশিত হবার সুযোগ খুব একটা থাকেনা।
আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রাইমারি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত আসতে আসতে ঝরে যায় প্রায় দুই তৃতীয়াংশ ছাত্র-ছাত্রী। ফলাফল বিশ্লেষণে একটা বিষয় পরিস্কার যে, প্রতিবছরই পাসের হার এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তির হার বৃদ্ধির সাথে সাথে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে, যা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। ২০০৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত এ পাঁচ বছরে উচ্চ মাধ্যমিকে ঝরে পড়াদের হার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়:
২০০৭ সালে পরীক্ষায় অংশ নেয় ৫ লাখ ৩৩ হাজার ১৫৮ জন। এর মধ্যে পাস করে ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৭৪৯ জন। অকৃতকার্য হয়ে ঝরে পড়ে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৪০৯ জন। ২০০৮ সালে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ৬ লাখ ১২ হাজার ৩৮১ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে পাস করে ৪ লাখ ৬৬ হাজার ৫৭০ জন। অকৃতকার্য হয়ে ঝরে পড়ে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৮১১ জন। ২০০৯ সালে ৬ লাখ হাজার ৮৭২ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। এর মধ্যে পাস করে ৪ লাখ ৪২ হাজার ৩৮৯ জন। ওই বছর ঝরে পড়ে ১ লাখ ৬৫ হাজার ৪৭৩ জন। ২০১০ সালে ৭ লাখ ১৮ হাজার ৮৪ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিলেও পাস করে ৫ লাখ ৩৩ হাজার ৩৬৯ জন। ঝরে পড়ে ১ লাখ ৮৪ হাজার ৭১৫ জন। ২০১১ সালে এ বছর ৭ লাখ ৬৪ হাজার ৮২৮ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছেন ৫ লাখ ৭৪ হাজার ২৬১ জন। ঝরে পড়েছে বা ফেল করেছে ১ লাখ ৯০ হাজার ৫৬৭ জন। অর্থ্যাৎ ২০০৭ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এ ৫ বছরে পাসের হার যেমন বেড়েছে, তেমনি ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বেড়েছে প্রতিবছরই। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে স্কুল কর্তৃপক্ষ যেমন উদাসীন তেমনি সরকারের কোন উদ্যোগও চোখে পড়ছে না। সরকার পাসের হার বৃদ্ধির ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিলেও ঝরে পড়াদের ব্যাপারে তেমন কোন উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা নেই। সরকার প্রতিবছরই লিখিত ও মৌখিক দু'ধরনের পরীক্ষায়ই পাসের হার বাড়াতে পরীক্ষকদের একাধিকবার নির্দেশ দিয়ে জিপিএ-৫ এর সংখ্যা এবং পাসের হার বৃদ্ধির চেষ্টা করে সফলতা অর্জন করেছে ঠিকই, কিন্তু শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ ঘটাতে পারছেনা। সৃষ্টিশীল শিক্ষার্থী তৈরি করতে পারছেনা। সরকারের এ উদারনীতির ফলে তাদের রাজনৈতিক ফায়দা কিছুটা হাসিল হলেও জাতি একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের দিকে ক্রমাগতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে এইচএসসি পাশের পরে তাদেরকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন সংকটের প্রেক্ষিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ঝুকে পড়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের দিকে আরও একধাপ এগিয়ে যাচ্ছে। তাহলে আমাদের এ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ কী?
ড. বেগম জাহান আরা, সাবেক প্রফেসর, ইনস্টিটিউট অব মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজেস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: গত ১৭.০১.২০১১ ইং তারিখে দৈনিক সমকাল পত্রিকায় 'আরও নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়!' (তিনি ! চিহ্ন দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন, আর কোন নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন নেই, যারা আছে তারাই লুটে পুটে খাক) শিরোনামে লিখেছেন-
(১) দেশ স্বাধীন হলো ১৯৭১ সালে। তখন দেশে ছিল ৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৭.৫ কোটি। স্বাধীনতার ২০ বছর পর উচ্চশিক্ষার জন্য যে তরুণ প্রজন্ম তৈরি হলো, তাদের জন্য শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা অনিবার্য হয়ে পড়ল। সেই সুযোগই এনে দিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় ২০ বছর সময়ের মধ্যে এখন দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৫১টি (সরকার বলছে ৫৪/৫৬টি) বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।
-ড. বেগম জাহানারা হয়তো জানেননা যে, তরুণ প্রজন্মের জন্য শিক্ষার সুযোগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এনে দেয়নি। সরকার দিয়েছে। সরকার তাদেরকে শিক্ষাদানের/শিক্ষা সেবার সূযোগ দিয়েছে। কিন্তু কুলাঙ্গাররা সেটাকে পন্য ও ব্যবসায়ে পরিণত করেছে। সনদ বানিজ্য করছে। লেখাপড়া যা হচ্ছে, তা অশ্বডিম্ব।
(২) ইউজিসির নিয়ম অমান্য করায় সমপ্রতি ২২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য 'রেড এলার্ট' ঘোষণা করা হয়েছে। নিয়ম অমান্য করার প্রধান কারণ এক একর জমির ওপর নিজস্ব স্থায়ী ক্যামপাস তৈরি না করা। আগে ছিল ৫ একর জমির শর্ত। ঢাকা নগরে এক সঙ্গে ৫ একর জমি তো দূরের কথা, একটি প্লটে এক একর অর্থাৎ তিন বিঘা জায়গা পাওয়াও অসম্ভব।
-ড. জাহানারার এ বিষয়ে কোন কিছু বলার অর্থই হচ্ছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষাবলম্বন করা। ১৯৯২ সনে যখন আইনটি হয়, তখনই এ ধারাটি ছিল, কাজেই এ ১৮ বছরে তারা যে পরিমান টাকা আয় করেছে, তা দ্বারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত একটা বিশাল আয়তনের এক একটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সম্ভব। অপেক্ষা করুন, আমি প্রমাণ দিচ্ছি। ঢাকায় জায়গা না পেলে ঢাকার আশেপাশেতো জমির কোনই অভাব নেই। তারা বিম্ববিদ্যালয়ের টাকায় নিজেদের নামেতো কম স্থাবর-অস্থাবর সমপদ বা জমি কেনেননি? ঢাকার উপর থেকে জনসংখ্যার চাপ কমানোর জন্য হলেও ঢাকার বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস করলে সেখানে ছাত্র-ছাত্রী যাবেনা, এ ধুয়োতো তোলা যাবেনা। পড়াশোনার জন্য ছাত্ররা জাহান্নাম বলেন আর স্বর্গ বলেন সবখানেই যাবে। উদাহরণ দেয়ার কোন প্রয়োজন আছে কি? প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন।
(৩) জনবহুল এ দেশে একটি বাড়ি ভেঙে ২০-২২ টি ফ্ল্যাট হচ্ছে। সেখানেও মানুষ বসবাস করছে। জমি তো সেই ১০ কাঠা বা এক বিঘা। তো ফ্লোর স্পেস হিসাব করলে এক বিঘার ওপর ২০ বা ৪০টি ফ্ল্যাটের ফ্লোর স্পেস দাঁড়ায় ২০ বা ৪০ বিঘা। এটি তো সাধারণ অঙ্ক। ঘিঞ্জি বসতির এ দেশে এভাবে জমির হিসাব না করলে চলবে কেন?
-ম্যাডাম যা হিসাব দেখালেন, সেরকমওতো কেউ করে দেখালোনা এ পর্যন্ত। এখনোতো সবাই হোটেলের উপর, গার্মেন্টসের উপর, মার্কেটের উপর, মুদি দোকানের মত করে ব্যবসা করে যাচ্ছে। আপনার মত একজন শিক্ষিত মহিলার কাছ থেকে এ ধরনের লেখা আমরা কেউই আশা করি না। এসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যা চলছে, তা তুঘলকি কান্ড ছাড়া আর কিছুই নয়। বছরে লাখ টাকার উপরে টিউশন ফি আদায় করছে এক একজন ছাত্রের কাছ থেকে, আর এক একজন শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বেতন দিচ্ছে তাতে তাদের পেটও চলেনা। আর শিক্ষা দেবার মত যাদের যোগ্যতা আছে, তারাও সঠিকভাবে সে শিক্ষাটা দান করছেনা। শিক্ষকরা সেটুকুই দিচ্ছে, যেটুকু ঐ বেতনের বিনিময়ে দেয়া দরকার। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আর শিক্ষকদের মাঝখানে পড়ে অসহায়, বঞ্চিত ও প্রতারিত হচ্ছে ছাত্ররা। এক একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মাথাপিছু ব্যয় দেখলে সহজেই অনুমান করা যায়, নেয়া এবং দেয়ার মধ্যে আসমান-জমিন পার্থক্য।
(৪) সবকিছু গড়তে সময় লাগে। সংশোধনেও সময় লাগে।
-এ ব্যাপারে বলা যায়, যার এক-এ হয়না, তার একশোতেও হয়না। চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী। কথাটা আপনার জানা ও বোঝা দরকার। এসব হারামখোরেরা যেহেতু এ ১৭-১৮ বছরেও সংশোধন হয়নি, আর তাদের হবারও দরকার নেই। এখন তাদেরকে বন্ধ করে দিয়ে সমসংখ্যক নতুন বিশ্ববিদ্যালয় চালু করলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আর এসব ব্যবসায়ীদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেশছাড়া করা অত্যন্ত জরুরী। এদেশে শিক্ষানুরাগী, শিক্ষাউদ্যোক্তার প্রয়োজন রয়েছে, শিক্ষা ব্যবসায়ী ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের কোন প্রয়োজন নেই। যেখানে পারে সেখানে গিয়ে এ ব্যবসা করুক। কেউ বাধা দিবেনা। কিন্তু এদেশে এটা চলতে দেয়া বিবেকবানদের উচিৎ নয়। আপনার লেখা এর আগেও পড়েছি। কিন্তু বক্তব্য একই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে সাফাই গাওয়া (দালালী করা) ।
আজকাল দেখা যায়, প্রাইমারী থেকে শুরু করে জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি, গ্রাজুয়েশন, পোস্ট গ্রাজুয়েশনে কোন কোন প্রতিষ্ঠান কতটা সাফল্য অর্জন করতে পেয়েছে, কোন কোন প্রতিষ্ঠান শতভাগ পাশ করেছে-ফলাফল প্রকাশের পর থেকে এসব প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে মাসখানেক নিয়মিত নাতিদীর্ঘ কলাম, নিবন্ধ, প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়ে থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব প্রতিষ্ঠানের এত ভাল ফলাফল অর্জনের গুরু রহস্য কি? আসলে কিছুইনা। এসব প্রতিষ্ঠানে ইন্টারভিউ নিয়ে যাচাই-বাছাই করে সেরা ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ভর্তি করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা বাসায় পিতা-মাতার কাছে, প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের কাছে, কোচিং সেন্টাওে ও প্রাইভেট পড়ে তারা তাদের সফলতা প্রমাণ করে। এতে ঐ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কৃতিত্ব ২৫-৩৫% এর বেশি নয় কোনক্রমেই। ঐসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদেরকে গ্রামের অজপাড়াগায়ের একটি প্রতিষ্ঠানে এক বছরের জন্য পাঠিয়ে দিয়ে দেখা যেতে পারে তারা অজপাড়াগায়ের একটি প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে কতটা ভাল ফলাফল অর্জনে সহায়তা করতে পারে। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, ঐ ২৫-৩০% এর বেশি তারা সাফল্য অর্জন করতে পারবেনা। ভাল প্রতিষ্ঠানে ভর্তিকৃত একজন ছাত্রের মেধা থাকে ৫০%। আর ২৫% শিক্ষকদের কর্তৃক প্রতিষ্ঠানে বিকশিত হয়, বাকীটা অভিভাবকদের কেয়ারনেস এবং প্রাইভেট টিউটর/কোচিং ইত্যাদির মাধ্যমে অর্জিত হয়। অজপাড়াগায়ের একটি প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত একজন ছাত্রের মেধা থাকে ২৫-৩৫%। অভিভাবকদের বেশিরভাগই অশিক্ষিত হওয়ায় অভিভাবকের কেয়ারনেস এবং টাকা পয়সার অভাবে কোচিং/প্রাইভেট এর মাধ্যমে জ্ঞানার্জন প্রায় শুন্যের কোঠায়। আর ২০-২৫% জ্ঞানার্জন করে প্রতিষ্ঠানে। আমার এ হিসাবে ১৯-২০ হতে পারে, তবে অজপাড়াগায়ের একটি প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত একজন ছাত্রের মধ্যে বেশিরভাগের পক্ষেই ভাল ফলাফল অর্জন করা সম্ভব হয়না এ কারনেই । আর যারা ভাল রেজাল্ট করে, তাদের উপর আল্লাহর একটা বিশেষ রহমত থাকে-এবং এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। এ কারনেই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পূর্বে অথবা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ভাল রেজাল্ট করতে বিফল হয়ে প্রতি বছর ঝরে পড়ে প্রায় ২ লাখ শিক্ষার্থী। আর যারা ঝরে পড়ছে তাদের ৯৯ ভাগই গ্রামাঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। শহুরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (ভাল) শিক্ষার্থী ভর্তির প্রতিযোগিতার কাছে হেরে গিয়ে তাদেরকে এ পরিস্থিতি বরণ করতে হয়। গ্রামাঞ্চলের এসব শিক্ষার্থীদের ধারনা, ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে না পারলে লেখাপড়া করে কী হবে? এ ধারনার বশবর্তী হয়েও এইচএসসি পাশের পর অনেকেই পড়ালেখার প্রতি বিমুখ হয়ে পড়ে। এছাড়া অর্থনৈতিক দূর্বলতার কারনে এসএসসি পাসের পর মেয়েদের মধ্যে অনেকেরই বিয়ে হয়ে যাওয়াও আরেকটা কারণ বলে মনে করা হয়ে থাকে।
দুই লাখ শিক্ষার্থীর ওপরে ফেল করার বা ঝরে পড়ার বিষয়টি একটা জাতির জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক, পীড়াদায়ক ও দুঃখজনকও বটে। ঝরে পড়া বা পরীক্ষায় ফেল করার প্রেক্ষিতে আত্মহননের ঘটনাও ঘটে চলছে প্রতিবছরই। তাই পাসের হার বাড়লেই চলবে না ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের দিকটাও দেখতে হবে। কেন তারা পারছে না? কোথায় তাদের সমস্যা? কেন একজন শিক্ষার্থী ফেল করে? কেন একজন শিক্ষার্থী রেজিস্ট্রেশন করেও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে? তার সঠিক কারন খুঁজে বের করে সমাধান করতে হবে। একথা মনে রাখা দরকার যে, পাসের হার বৃদ্ধি আর শিক্ষার মান এক জিনিস নয়। সবাইকে পাস করতে হবে। এ ধরনের মানসিকতা আমাদেরকে তৈরি করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা আর ফেল করা, ঝরে পড়া, আত্মহনন চাইনা। এ লক্ষ্য নিয়েই আমাদের সামনে অগ্রসর হওয়া উচিৎ। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র। তাদের ভিটে-বাড়ি বিক্রি করে ছেলে-মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করায় চাকরির আশায়। উন্নত দেশের ছেলে-মেয়েরা উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পরপরই চাকরি করার সুযোগ পায়। আমাদের দেশে সে সুযোগ নেই। এজন্য আমাদের দেশে শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষত, যোগ্য ও অর্ধযোগ্য বেকারের সংখ্যা বেশি।
গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এ ফলাফল বিপর্যয়ের অন্যতম কারন হলো, কোন ভাল ছাত্র উচ্চশিক্ষার পাট শেষ করার পর শিক্ষকতার পেশায় আসতে চায়না, আবার শিক্ষকতার পেশায় যুক্ত হলেও বেশিরভাগই গ্রামের কোন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হতে চায়না। সবাই শহরমূখী হয়ে পড়ে। যারা গ্রামাঞ্চলের প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকতা করে, তাদের অনেকেরই শিক্ষকতা করার কোন যোগ্যতাই নেই। এসব অর্ধযোগ্য শিক্ষকের কারনে গ্রামের ছাত্রদের মেধা বিকশিত হবার সুযোগ খুব একটা থাকেনা।
আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রাইমারি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত আসতে আসতে ঝরে যায় প্রায় দুই তৃতীয়াংশ ছাত্র-ছাত্রী। ফলাফল বিশ্লেষণে একটা বিষয় পরিস্কার যে, প্রতিবছরই পাসের হার এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তির হার বৃদ্ধির সাথে সাথে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে, যা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। ২০০৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত এ পাঁচ বছরে উচ্চ মাধ্যমিকে ঝরে পড়াদের হার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়:
২০০৭ সালে পরীক্ষায় অংশ নেয় ৫ লাখ ৩৩ হাজার ১৫৮ জন। এর মধ্যে পাস করে ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৭৪৯ জন। অকৃতকার্য হয়ে ঝরে পড়ে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৪০৯ জন। ২০০৮ সালে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ৬ লাখ ১২ হাজার ৩৮১ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে পাস করে ৪ লাখ ৬৬ হাজার ৫৭০ জন। অকৃতকার্য হয়ে ঝরে পড়ে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৮১১ জন। ২০০৯ সালে ৬ লাখ হাজার ৮৭২ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। এর মধ্যে পাস করে ৪ লাখ ৪২ হাজার ৩৮৯ জন। ওই বছর ঝরে পড়ে ১ লাখ ৬৫ হাজার ৪৭৩ জন। ২০১০ সালে ৭ লাখ ১৮ হাজার ৮৪ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিলেও পাস করে ৫ লাখ ৩৩ হাজার ৩৬৯ জন। ঝরে পড়ে ১ লাখ ৮৪ হাজার ৭১৫ জন। ২০১১ সালে এ বছর ৭ লাখ ৬৪ হাজার ৮২৮ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছেন ৫ লাখ ৭৪ হাজার ২৬১ জন। ঝরে পড়েছে বা ফেল করেছে ১ লাখ ৯০ হাজার ৫৬৭ জন। অর্থ্যাৎ ২০০৭ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এ ৫ বছরে পাসের হার যেমন বেড়েছে, তেমনি ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বেড়েছে প্রতিবছরই। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে স্কুল কর্তৃপক্ষ যেমন উদাসীন তেমনি সরকারের কোন উদ্যোগও চোখে পড়ছে না। সরকার পাসের হার বৃদ্ধির ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিলেও ঝরে পড়াদের ব্যাপারে তেমন কোন উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা নেই। সরকার প্রতিবছরই লিখিত ও মৌখিক দু'ধরনের পরীক্ষায়ই পাসের হার বাড়াতে পরীক্ষকদের একাধিকবার নির্দেশ দিয়ে জিপিএ-৫ এর সংখ্যা এবং পাসের হার বৃদ্ধির চেষ্টা করে সফলতা অর্জন করেছে ঠিকই, কিন্তু শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ ঘটাতে পারছেনা। সৃষ্টিশীল শিক্ষার্থী তৈরি করতে পারছেনা। সরকারের এ উদারনীতির ফলে তাদের রাজনৈতিক ফায়দা কিছুটা হাসিল হলেও জাতি একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের দিকে ক্রমাগতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে এইচএসসি পাশের পরে তাদেরকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন সংকটের প্রেক্ষিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ঝুকে পড়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের দিকে আরও একধাপ এগিয়ে যাচ্ছে। তাহলে আমাদের এ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ কী?
ড. বেগম জাহান আরা, সাবেক প্রফেসর, ইনস্টিটিউট অব মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজেস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: গত ১৭.০১.২০১১ ইং তারিখে দৈনিক সমকাল পত্রিকায় 'আরও নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়!' (তিনি ! চিহ্ন দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন, আর কোন নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন নেই, যারা আছে তারাই লুটে পুটে খাক) শিরোনামে লিখেছেন-
(১) দেশ স্বাধীন হলো ১৯৭১ সালে। তখন দেশে ছিল ৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৭.৫ কোটি। স্বাধীনতার ২০ বছর পর উচ্চশিক্ষার জন্য যে তরুণ প্রজন্ম তৈরি হলো, তাদের জন্য শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা অনিবার্য হয়ে পড়ল। সেই সুযোগই এনে দিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় ২০ বছর সময়ের মধ্যে এখন দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৫১টি (সরকার বলছে ৫৪/৫৬টি) বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।
-ড. বেগম জাহানারা হয়তো জানেননা যে, তরুণ প্রজন্মের জন্য শিক্ষার সুযোগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এনে দেয়নি। সরকার দিয়েছে। সরকার তাদেরকে শিক্ষাদানের/শিক্ষা সেবার সূযোগ দিয়েছে। কিন্তু কুলাঙ্গাররা সেটাকে পন্য ও ব্যবসায়ে পরিণত করেছে। সনদ বানিজ্য করছে। লেখাপড়া যা হচ্ছে, তা অশ্বডিম্ব।
(২) ইউজিসির নিয়ম অমান্য করায় সমপ্রতি ২২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য 'রেড এলার্ট' ঘোষণা করা হয়েছে। নিয়ম অমান্য করার প্রধান কারণ এক একর জমির ওপর নিজস্ব স্থায়ী ক্যামপাস তৈরি না করা। আগে ছিল ৫ একর জমির শর্ত। ঢাকা নগরে এক সঙ্গে ৫ একর জমি তো দূরের কথা, একটি প্লটে এক একর অর্থাৎ তিন বিঘা জায়গা পাওয়াও অসম্ভব।
-ড. জাহানারার এ বিষয়ে কোন কিছু বলার অর্থই হচ্ছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষাবলম্বন করা। ১৯৯২ সনে যখন আইনটি হয়, তখনই এ ধারাটি ছিল, কাজেই এ ১৮ বছরে তারা যে পরিমান টাকা আয় করেছে, তা দ্বারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত একটা বিশাল আয়তনের এক একটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সম্ভব। অপেক্ষা করুন, আমি প্রমাণ দিচ্ছি। ঢাকায় জায়গা না পেলে ঢাকার আশেপাশেতো জমির কোনই অভাব নেই। তারা বিম্ববিদ্যালয়ের টাকায় নিজেদের নামেতো কম স্থাবর-অস্থাবর সমপদ বা জমি কেনেননি? ঢাকার উপর থেকে জনসংখ্যার চাপ কমানোর জন্য হলেও ঢাকার বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যামপাস করলে সেখানে ছাত্র-ছাত্রী যাবেনা, এ ধুয়োতো তোলা যাবেনা। পড়াশোনার জন্য ছাত্ররা জাহান্নাম বলেন আর স্বর্গ বলেন সবখানেই যাবে। উদাহরণ দেয়ার কোন প্রয়োজন আছে কি? প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন।
(৩) জনবহুল এ দেশে একটি বাড়ি ভেঙে ২০-২২ টি ফ্ল্যাট হচ্ছে। সেখানেও মানুষ বসবাস করছে। জমি তো সেই ১০ কাঠা বা এক বিঘা। তো ফ্লোর সপেস হিসাব করলে এক বিঘার ওপর ২০ বা ৪০টি ফ্ল্যাটের ফ্লোর সপেস দাঁড়ায় ২০ বা ৪০ বিঘা। এটি তো সাধারণ অঙ্ক। ঘিঞ্জি বসতির এ দেশে এভাবে জমির হিসাব না করলে চলবে কেন?
-ম্যাডাম যা হিসাব দেখালেন, সেরকমওতো কেউ করে দেখালোনা এ পর্যন্ত। এখনোতো সবাই হোটেলের উপর, গার্মেন্টসের উপর, মার্কেটের উপর, মুদি দোকানের মত করে ব্যবসা করে যাচ্ছে। আপনার মত একজন শিক্ষিত মহিলার কাছ থেকে এ ধরনের লেখা আমরা কেউই আশা করি না। এসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যা চলছে, তা তুঘলকি কান্ড ছাড়া আর কিছুই নয়। বছরে লাখ টাকার উপরে টিউশন ফি আদায় করছে এক একজন ছাত্রের কাছ থেকে, আর এক একজন শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বেতন দিচ্ছে তাতে তাদের পেটও চলেনা। আর শিক্ষা দেবার মত যাদের যোগ্যতা আছে, তারাও সঠিকভাবে সে শিক্ষাটা দান করছেনা। শিক্ষকরা সেটুকুই দিচ্ছে, যেটুকু ঐ বেতনের বিনিময়ে দেয়া দরকার। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আর শিক্ষকদের মাঝখানে পড়ে অসহায়, বঞ্চিত ও প্রতারিত হচ্ছে ছাত্ররা। এক একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মাথাপিছু ব্যয় দেখলে সহজেই অনুমান করা যায়, নেয়া এবং দেয়ার মধ্যে আসমান-জমিন পার্থক্য।
(৪) সবকিছু গড়তে সময় লাগে। সংশোধনেও সময় লাগে।
-এ ব্যাপারে বলা যায়, যার এক-এ হয়না, তার একশোতেও হয়না। চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী। কথাটা আপনার জানা ও বোঝা দরকার। এসব হারামখোরেরা যেহেতু এ ১৭-১৮ বছরেও সংশোধন হয়নি, আর তাদের হবারও দরকার নেই। এখন তাদেরকে বন্ধ করে দিয়ে সমসংখ্যক নতুন বিশ্ববিদ্যালয় চালু করলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আর এসব ব্যবসায়ীদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেশছাড়া করা অত্যন্ত জরুরী। এদেশে শিক্ষানুরাগী, শিক্ষাউদ্যোক্তার প্রয়োজন রয়েছে, শিক্ষা ব্যবসায়ী ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের কোন প্রয়োজন নেই। যেখানে পারে সেখানে গিয়ে এ ব্যবসা করুক। কেউ বাধা দিবেনা। কিন্তু এদেশে এটা চলতে দেয়া বিবেকবানদের উচিৎ নয়। আপনার লেখা এর আগেও পড়েছি। কিন্তু বক্তব্য একই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে সাফাই গাওয়া (দালালী করা)।
ব্লগে মন্তব্য করুন অথবা মেইল করুন: sangsaptaka@rocketmail.com
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়: প্রাসঙ্গিক ভাবনা-১
Reviewed by MyBlog
on
May 15, 2012
Rating: 5
No comments
Post a Comment