Breaking News

সরকার ভর্তি বন্ধ করে দিচ্ছে ১১ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে



মুসতাক আহমদ

প্রকাশ: দৈনিক যুগান্তর, ১৬ জুলাই, ২০১৩

১১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ করে দেয়ার চিন্তাভাবনা চলছে। সরকার মনে করছে, এসব বিশ্ববিদ্যালয় কোনো আইন-কানুনই মানছে না। তারা শিক্ষার নামে বাণিজ্য করছে। করছে সনদ ব্যবসা। তাই এখন গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ করা হবে।

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, আগামী ১০ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে বৈঠক করে সেখানে বিস্তারিত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। পরে জারি করা হবে গণবিজ্ঞপ্তি। এরপরও যদি ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ ভর্তি হয়, তাহলে সে দায়দায়িত্ব সংশ্লিষ্টদের।

তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সরকার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়কে চিহ্নিত করলেও এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি। দুই দফায় আড়াই বছরের বেশি সময় দেয়ার পরও সরকারের নির্দেশনা মানেনি এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩৯টি। প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছর হয়ে গেছে কিন্তু স্থায়ী ক্যাম্পাসে যায়নি, আউটার ক্যাম্পাস ব্যবসা বন্ধ করেনি, বরং অ্যানেক্স ক্যাম্পাসের নামে নয়া বাণিজ্য খুলেছে, ভাঁওতাবাজি করে ট্রাস্টি বোর্ড প্রতিষ্ঠা না করে তথাকথিত ফাউন্ডেশনের নামে কিয়দংশ জমি কিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বলে দেখাচ্ছে, আইনানুযায়ী জমি না কিনে আংশিক কিনে তাতে ক্যাম্পাস স্থাপন করেছে, নকশা অনুমোদনের নামে দিনের পর দিন মুলা ঝুলিয়ে রেখেছে এমন নানা দোষে দুষ্ট এসব প্রতিষ্ঠান। এছাড়া আরও ২টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যেগুলো আদালতের আদেশে চলছে, কিন্তু সরকার স্বীকৃতি দেয়নি।

তবে আড়াই বছর ধরে চাপাচাপির পর কিছু জমি কিনেছে, তাতে ক্যাম্পাস স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে, নকশা তৈরির জন্য আবেদন করেছে- কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ধরনের উদ্যোগেই রহস্যজনক কারণে সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায় খুশি।

শিক্ষামন্ত্রী এ ব্যাপারে বলেন, আমরা যখন শুরু করেছি, তখন এমন অবস্থাও ছিল না। নিজের স্থায়ী ক্যাম্পাস হতে পারে- অনেকে এমনটি কল্পনাও করতে পারত না। আমাদের চাপাচাপিতে অনেকেই ক্যাম্পাস গড়েছে। তিনি আরও বলেন, তারপরও ১১টি প্রতিষ্ঠান কোনো ধরনেরই উদ্যোগ নেয়নি। সেগুলোর ব্যাপারে আমরা কঠোর হব।

দুই দফায় আলটিমেটাম দেয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা কী- এ নিয়ে পর্যালোচনা ও সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যই সোমবার বিকালে মন্ত্রণালয়ে উচ্চপর্যায়ের সভা বসে। এতে সভাপতিত্ব করেন শিক্ষামন্ত্রী। এতে যোগ দেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান (প্রতিমন্ত্রী) অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরী, শিক্ষা সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক আতফুল হাই শিবলী, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সালাউদ্দিন আকবর প্রমুখ যোগদান করেন। বৈঠকের নথিপত্রে দেখা গেছে, সরকার ১৫টি পুরনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্থায়ী ক্যাম্পাসে গেছে বলে ধরে নিচ্ছে। ওইগুলো হচ্ছে- নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চট্টগ্রাম, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি, আহছানউল্লাহ্ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি, সিটি ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি, গণবিশ্ববিদ্যালয়, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়-চট্টগ্রাম।

তবে এ ১৫টির মধ্যে বেশ কয়েকটি নানা দোষে দুষ্ট। নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ড সংক্রান্ত জটিলতা রয়েছে। ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে এমবিবিএস প্রোগ্রাম চালাচ্ছে। সরকারি আদেশে এ ধরনের প্রোগ্রাম চালানোর অনুমতি নেই। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজিও একইভাবে মেডিকেল প্রোগ্রাম চালাচ্ছে। একই অবস্থা গণবিশ্ববিদ্যালয়েরও। সরকারি নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এই তিনটির কেউ এমবিবিএস আবার কেউ এমবিবিএসসহ ডেন্টাল প্রোগ্রাম পর্যন্ত চালাচ্ছে। রয়েছে নার্সিং প্রোগ্রামও। আহছানউল্লাহ্ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি সংক্রান্ত জটিলতা রয়েছে। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির কার্যক্রম ব্র্যাক ভবনেও রয়েছে। তারা নির্ধারিত জমিতে আংশিক শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির সিদ্ধেশ্বরী ক্যাম্পাস শর্তসাপেক্ষে অনুমোদিত, শর্তহীন নয়। সিটি ইউনিভার্সিটি বনানীর ভবনেও আংশিক কার্যক্রম চালাচ্ছে, ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি নিজস্ব জমিতে আংশিক কার্যক্রম চালাচ্ছে। বিজিসি ট্রাস্ট এবং আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় একটি চট্টগ্রাম শহরে, আরেকটি ঢাকায় আউটার ক্যাম্পাস চালাচ্ছে, যা আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে চলছে, যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয় আউটার ক্যাম্পাস কার্যক্রম ২০০৭ সালেই বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে।

বর্তমান সরকার মোট ৫ দফায় ১৯টি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে দুটি শুরু থেকেই স্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম চালাচ্ছে।

২০১০ সালের ডিসেম্বরে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এক বছরের সময় দিয়ে বলা হয়েছিল, যেসব বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব (স্থায়ী) ক্যাম্পাসে যেতে ব্যর্থ হবে, তারা ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরের পর আর শিক্ষার্থী ভর্তি করতে পারবে না। এর চার মাস পর ২০১২ সালের জানুয়ারিতে নিজস্ব ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আরও এক বছর সময় দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেই সময়ও পার হয়েছে গত বছরের ডিসেম্বরে। আইনানুযায়ী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছরের মধ্যে নিজস্ব ক্যাম্পাসে যাওয়ার কথা।

ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরী বলেন, স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়া বা শিক্ষার মানের বিষয়টি সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বের বিষয়। তবে সেই সঙ্গে মালিকানা দ্বন্দ্বের বিষয়টিও অনেক উদ্বেগের বিষয়। এর কারণে মামলার জটিলতা রয়েছে। আর শিক্ষা সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, সঙ্গত কারণেই সরকারকে কঠোর হতে হচ্ছে। সরকার বোঝে কে কোন মতলব নিয়ে কী করছে।

যে ১১টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সরকার ১০ দিন পর মিটিং শেষে শিক্ষার্থী ভর্তির ব্যাপারে গণবিজ্ঞপ্তি দেয়ার চিন্তাভাবনা করছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি, প্রাইম ইউনিভার্সিটি, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি, পিপলস ইউনিভার্সিটি, ইবাইস ইউনিভার্সিটি ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে দারুল ইহসান, ইবাইস, অতীশ দীপঙ্কর, প্রাইম ও এশিয়ানের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে। মালিকানা দ্বন্দ্ব নিরসনে চিঠি দেয়ার পরও তারা উদ্যোগ নেয়নি। বরং একের পর এক মামলা দিয়ে পরস্পরকে ঘায়েলের চেষ্টা করছে তারা। এই পাঁচটির মধ্যে আবার দারুল ইহসান এবং প্রাইম এই দুটি একজন মাত্র ব্যক্তির কারণে ধ্বংসের পথে যাচ্ছে। মামলাবাজ ওই ব্যক্তি কথায় কথায় ইউজিসি এমনকি মন্ত্রণালয়কে বিবাদী করে মামলা ও উকিল নোটিশ দেয়ার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। এই ব্যক্তি বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের নেতা পরিচয় দেন নিজেকে। সরকারের দুজন উপদেষ্টার নামও বিক্রি করে থাকেন তিনি। তিনি একাই দারুল ইহসান আর প্রাইমের অর্ধশত ক্যাম্পাস চালাচ্ছেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্র মতে, বর্তমানে সারাদেশে ৭১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছর হয়ে গেছে ৫৪টির।

No comments