Breaking News

দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করছে সনদবাণিজ্য- অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী

পড়ালেখা, গবেষণা- এসব কিছুর ধার না ধেরে উচ্চশিক্ষার নামে পয়সার বিনিময়ে সনদ বিক্রির ব্যবসা শুধু দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করছে না, জাতিকেও পঙ্গু করে তুলবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন।

তিনি বলেন, 'দেশে মানহীন ও ভুয়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছড়িয়ে পড়েছে। অনুমোদিত একটি অথচ ক্যাম্পাস খুলেছে একাধিক। তার মধ্যে রয়েছে মালিকানার দ্বন্দ্ব। এ অবৈধ ক্যাম্পাসগুলোয় শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে। এগুলো শিক্ষা ও সনদ বাণিজ্য করতে আদালতের শরণাপন্নও হচ্ছে। মামলার রিট করছে। স্টে অর্ডার নিচ্ছে। মালিক সেজে সেগুলো আমাদের দেখাচ্ছে। এখন আদালতের দেওয়া স্টে অর্ডারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কোনো ধরনের ব্যবস্থাও নেওয়া যাচ্ছে না। তবে দেশের ভর্তিচ্ছু মেধাবী শিক্ষার্থীদের আমরা নির্দেশনা দিচ্ছি। ইউজিসি একটি তালিকা তুলে ধরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। সে বিজ্ঞাপন দেখে যেন শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়। না হলে ভবিষ্যতে তারা বিপদে পড়বে। শিক্ষা ব্যবসায়ীরা টাকার লোভে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। তাদের কাছ থেকে সাবধান হতে হবে।' এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, 'বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে শুধু রাজধানীতেই একাধিক সমস্যা রয়েছে। প্রাইম ইউনিভার্সিটির মালিকানা নিয়ে দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব। আবুল হোসেনের প্রাইম ইউনিভার্সিটি উত্তরা বিএনএস সেন্টারের ক্যাম্পাসসহ পরিচালিত আরও পাঁচটি শাখা সম্পূর্ণ অবৈধ। অথচ তারা আদালতের স্টে অর্ডার নিয়ে নানা বাণিজ্য করছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এগুলো বন্ধ করে দেওয়ার জন্য আমরা অনুরোধ করেছি।' তিনি বলেন, 'দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি গ্রুপ। এ চার গ্রুপ সারা দেশে ১৪০টি শাখা ক্যাম্পাস খুলেছে। দেদার সনদ বাণিজ্যও করছে বলে অভিযোগ পাচ্ছি নিয়মিত। আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দিয়েছি। এসব নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ও দুই মাস কাজ করেছে। ইউজিসি সহযোগিতা করেছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত করেছেন বিচারপতি এবাদুল হক। যিনি খুবই প্রজ্ঞাবান একজন মানুষ। বিচারপতি এবাদুল হক দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ বাতিলের সুপারিশ করেছেন। কিন্তু এসব বিষয় আইন মন্ত্রণালয় হয়ে আর আসে না। নিশ্চয়ই আইন মন্ত্রণালয়ের কেউ না কেউ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িত। নয় তো কারও আত্দীয়স্বজন এটি পরিচালনা করেন।'

অধ্যাপক আজাদ আরও বলেন, 'ধানমন্ডিতে ইবাইস নামের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা দ্বন্দ্ব রয়েছে। আপন দুই ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক দাবি করে পরস্পরবিরোধী মামলা করেছেন। দুই ভাই আলাদা ক্যাম্পাস পরিচালনা করছেন। সহজসরল শিক্ষার্থীরা ভালোমন্দ বুঝতে পারছে না। কোনটায় ভর্তি হবে। অনেকে ভুল পথে হাঁটছে। আর দোষ পড়ছে ইউজিসির ওপর। কোনো অবৈধ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়ে নিজের জীবন নষ্ট করুক আমরা চাই না। নর্দান ইউনিভার্সিটির অনুমোদন আছে একটি। ক্যাম্পাস খুলেছে চার-পাঁচটি। এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা আবার বঙ্গবন্ধুর নামে, শেখ হাসিনার নামে কটূক্তিও করেন। এসব অবৈধ ক্যাম্পাস বন্ধ করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুরোধ করেছি।'


ইউজিসি চেয়ারম্যান বলেন, 'আমি আমার আদর্শ এবং সততা বজায় রেখে আজীবন অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলে যাব। ইউজিসির চার সদস্যের একটি টিম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সরেজমিনে পরিদর্শন করছে। কয়জন শিক্ষক, কয়জন ছাত্র তার হিসাব নিচ্ছে। কোন প্রতিষ্ঠানের মান কেমন তা পর্যবেক্ষণ করছে। এগুলো দেখে গ্রেডিং করা হচ্ছে। কিছু দিনের মধ্যে প্রতিবেদন আকারে তা পেশ করা হবে। তখন শিক্ষার্থীরাই বুঝতে পারবে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া উচিত।' এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, 'যারা সনদ বাণিজ্য করছেন তারা অর্থলোভী। আর যারা নিচ্ছে তারা বাংলাদেশে ব্যবহার করতে না পারলে বিদেশে চাকরির জন্য ব্যবহার করছে। আবার অনেকে আছে অর্থবিত্তের মালিক। নামের আগে কিছু বিশেষণ লাগানো অথবা মানুষকে বলতে পারার জন্য একটি উচ্চশিক্ষার সনদ জোগাড় করছে। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিকই উপাচার্য। আবার উপাচার্যের বিশেষ সহকারী বলে একটি পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। সেখানে নিয়োগ দেখানো হয়েছে তারই ছেলেকে। একেবারে পারিবারিক ব্যবসায় নামিয়ে আনা হয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে। ব্যবসা নিশ্চয়ই খারাপ কিছু নয়। কিন্তু ক্লাস, পড়ালেখা বা গবেষণা এসব কিছুর ধার না ধেরে উচ্চশিক্ষার নামে পয়সার বিনিময়ে সনদ বিক্রির ব্যবসা শুধু দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করছে না, জাতিকেও পঙ্গু করে তুলবে।' তিনি বলেন, 'অতীশ দীপঙ্কর ইউনিভার্সিটি নিয়ে নানা দ্বন্দ্ব। চারজনে চারটি ক্যাম্পাস খুলে পরিচালনা করছেন। একাধিক ট্রাস্টি বোর্ডও ছিল। কিছু দিন আগে আনোয়ারা বেগমকে চেয়ারম্যান করে একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করে দেওয়া হয়েছে। তার পরেও মূল ক্যাম্পাস রেখে বাকিগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়নি।' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই উপাচার্য বলেন, 'বিশ্বায়নের এই যুগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হচ্ছে নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা। পাবলিক-প্রাইভেট বিভাজন না রেখে প্রতিযোগিতা করা। মানের দিক থেকে সেরা হওয়া। এ ধরনের কার্যক্রমের চর্চা হলে একসময় শিক্ষার্থীদের মনেও সরকারি আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বিভেদ থাকবে না। কিন্তু ইউজিসির হাতে কোনো ক্ষমতা নেই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার। তবে প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো কি মন্দ তার প্রতিবেদন দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নিয়মিত অবহিত করা হয়। মন্ত্রণালয়ই এগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে পারে।' তিনি বলেন, 'কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যদি ভালো কিছু উদ্ভাবন করে, জ্ঞান সৃষ্টি করে দেশ ও জাতির উন্নয়নের জন্য, সে ক্ষেত্রে ইউজিসি এক মিলিয়ন ডলার ফান্ডিং করবে। ইউজিসি সবসময় উচ্চশিক্ষার সার্বিক বিষয় মনিটরিং করে।'

No comments