Breaking News

সনদনির্ভর বিশ্ববিদ্যালয় নিষিদ্ধ ক্যাম্পাসও চালু

দৈনিক প্র্রথম আলো
মোশতাক আহমেদ | আপডেট: ০২:১০, আগস্ট ০৭, ২০১৪ | প্রিন্ট সংস্করণ
   
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়উত্তরায় মালিকের চারতলা বাসার দুই তলা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রশাসনিক কার্যালয়। মালিকই উপাচার্য। ১৬ বছর ধরে তিনি উপাচার্য। ছেলের জন্য বিশেষ সহকারী টু ভিসি (এসএভিসি) নামে পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। সেই ছেলে একটি বিভাগের প্রধান ও অনুষদের ডিন। উপাচার্যের অসুস্থতার কারণে তাঁর ছেলেই পরোক্ষভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ব্যক্তি। বিশ্ববিদ্যালয়টি সম্পূর্ণ সনদনির্ভর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখানে অনেকটা টাকা দাও, সনদ নাওধরনের ব্যবস্থা।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গত ৩০ জুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়শিরোনামে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এভাবে। বিস্তারিত প্রতিবেদন গত ৭ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অননুমোদিত শাখা ক্যাম্পাস খোলাসহ নানা অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়। তবে টিআইবি তার নীতি অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাম প্রকাশ করেনি।

টিআইবির প্রতিবেদনের বর্ণনা অনুযায়ী প্রথম আলো খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, উত্তরায় অবস্থিত উচ্চশিক্ষার ওই প্রতিষ্ঠানটির নাম এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টির এসএভিসি, একটি বিভাগের প্রধান ও একটি অনুষদের ডিনএই তিন পদে আছেন মোহাম্মদ জাফর সাদেক। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য ও মালিক আবুল হাসান মোহাম্মদ সাদেকের ছেলে এবং ট্রাস্টি বোর্ডেরও চেয়ারম্যান।

এশিয়ান ইউনিভার্সিটি সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৯৯৬ সালে অনুমোদন পায়। আবুল হাসান মোহাম্মদ সাদেক এককালীন টাকা অনুদান করায় বোর্ড অব গভর্নরসের প্রথম সভায় তাঁকে প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান করা হয়। তিনি প্রথম দফায় ১৯৯৬-২০০০ মেয়াদে উপাচার্য হন। কয়েক দফায় মিলিয়ে তিনি এখনো উপাচার্য। অভিযোগ রয়েছে, তিনি নিয়ম অনুযায়ী মালয়েশিয়ার ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটির শিক্ষকতা না ছেড়েই প্রথম দফায় উপাচার্যের দায়িত্ব নেন। একপর্যায়ে তাঁর সঙ্গে তাঁর ভাইদের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলে দুটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠিত হয়। সম্প্রতি এই দ্বন্দ্ব মিটেছে বলে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে।

আইন অনুযায়ী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস নিষিদ্ধ থাকলেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে মতিঝিলে একটি শাখা ক্যাম্পাস রয়েছে। টিআইবির প্রতিবেদনেও দুটি ক্যাম্পাসের উল্লেখ আছে। মূল ক্যাম্পাস উত্তরায়। শিক্ষা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মান নিয়ে তাদের চিন্তা-ভাবনা নেই। এখানে সহ-উপাচার্য, রেজিস্ট্রারের কার্যত কোনো ক্ষমতা নেই।
জানতে চাইলে জাফর সাদেক ঈদের আগে টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, এসব অভিযোগ সঠিক নয়। মতিঝিলের শাখাটি বন্ধ করে দেওয়া হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়টির একজন কর্মকর্তা বলেন, উত্তরায় ২৮ নম্বর রোডে উপাচার্যের বাসায় উপাচার্যের কার্যালয়, এটি প্রশাসনিক ভবন নয়। ৫ নম্বর রোডে একাডেমিক ভবন।

টিআইবির প্রতিবেদনে উত্তরার ওই বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে বলা হয়, সনদনির্ভর এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের গবেষণার কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করতে চান না, তাঁরা যত কম পড়াশোনা করে সনদ পাওয়া যায় ততই খুশি। যাঁরা চাকরি করেন, তাঁরা দূরদূরান্ত থেকে এসে শুধু শুক্রবার ক্লাস করলেও নিয়মিত শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রেও একই রকম চিত্র লক্ষণীয়। সত্যিকার অর্থে শিক্ষার্থীরা যেভাবে চান, সেভাবেই হয়। তাই দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টির পিয়ন-দারোয়ানও সেখানকার ডিগ্রি পেয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষকদের কোনো ক্ষমতা নেই। প্রভাষকেরা সাধারণত পাঁচ হাজার থেকে শুরু করে ২০ হাজার টাকা বেতন পান। শিক্ষার্থী প্রচুর। কারণ ক্লাস করতে হয় না। পরীক্ষার হলে প্রচুর নকল হয়। পরীক্ষায় সবাইকেই পাস করিয়ে দেওয়া হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকেরা বিভিন্নভাবে অর্থ নিয়ে থাকেন।

এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪০ শাখা ক্যাম্পাস: আইন অনুযায়ী শাখা ক্যাম্পাস খোলা নিষিদ্ধ হলেও টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪০টি পর্যন্ত অবৈধ ক্যাম্পাস খোলার দৃষ্টান্ত আছে। এসব ক্যাম্পাস ইউনিয়ন পর্যায়েও বিস্তৃত।

পরে প্রথম আলো ইউজিসিতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪০টি শাখা ক্যাম্পাস আছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টি চার ভাগে বিভক্ত। একটি অংশের মূল ক্যাম্পাস ধানমন্ডিতে, আরেকটি অংশের সাভারের গণকবাড়ীতে, অপর অংশের উত্তরায় এবং আরেকটি অংশের ক্যাম্পাস রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে সনদ-বাণিজ্যের অভিযোগ তদন্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন অভিযোগের সত্যতা পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির সনদ বাতিলের সুপারিশ করেছিল। মন্ত্রণালয় বলছে, মামলার কারণে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, তাঁরা মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করছেন।

নয় বিশ্ববিদ্যালয় চালাচ্ছে অননুমোদিত ক্যাম্পাস: শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, ১৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের অভিযোগ আছে। এর মধ্যে নয়টি অননুমোদিতভাবে ক্যাম্পাস চালাচ্ছে। এগুলো হলো: দারুল ইহসান, প্রাইম, এশিয়ান, অতীশ দীপঙ্কর, সাউদার্ন, নর্দান, দ্য পিপলস, বিজিসি ট্রাস্ট ও ইবাইস ইউনিভার্সিটি। এ ছাড়া আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, কুইন্স ইউনিভার্সিটিসহ আরও কয়েকটি নিয়ে মামলা চলছে। মালিকানা নিয়ে দুই ভাইয়ের দ্বন্দ্বে ইবাইস এখন কার্যত দুটি বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেছে। এক ভাই ধানমন্ডিতে ও আরেক ভাই উত্তরায় আলাদাভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছেন।

এসব বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ গত ৭ জুলাই সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেন, অনিয়মের কারণে ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও এগুলো মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে ৪৮টি রিট করে স্থগিতাদেশ নিয়ে টিকে আছে।

স্থায়ী সনদ দুটির: ৭৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৩২টি ১২ বছর অতিক্রম করেছে। কতগুলো সাত বছর পার করেছে। আইন অনুযায়ী সাময়িক অনুমোদন নিয়ে সাত বছর পর (নবায়নসহ সর্বোচ্চ ১২ বছর) শর্তগুলো পূরণ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্থায়ী সনদ নেবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাত্র দুটিআহসান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সিটি ইউনিভার্সিটি স্থায়ী সনদ নিয়েছে। আর মাত্র ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব ক্যাম্পাসে গেছে। আইন অনুযায়ী নিজস্ব ক্যাম্পাসে না যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা থাকলেও তা না করে মন্ত্রণালয় এ ক্ষেত্রে দফায় দফায় সময় বাড়িয়েছে।


সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষাসচিব মোহাম্মদ সাদিক গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ভালো করছে, আবার কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে মামলার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হচ্ছে। তবে সব বিশ্ববিদ্যালয়কে কাঠামোর মধ্যে আনতে আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি। এটা রাতারাতি সম্ভব নয়। তবে আমরা আশাবাদী।

No comments